• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অপরাধীদের ‘স্বর্গ’ চর বাঁচামারা!

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারি ২০২১  

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের একটি বাঁচামারা। ৯ হাজার ৫৮৩ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই ইউনিয়নের পদ্মা ও যমুনা নদী পাড়ের দুর্গম চরটি স্থানীয়দের কাছে ‘চর বাঁচামারা’ নামে পরিচিত। আর এই চরের গহিনে ঘাঁটি গেড়েছে খুন, চুরি, ডাকাতি ও মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত বহু মামলার দুর্ধর্ষ সব আসামি। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ৫ থেকে ১০টি মামলা রয়েছে। ঢাকা ও এর আশপাশের সাভার, আশুলিয়া, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় এরা অপরাধ করে আত্মগোপনে চলে যায় ‘চর বাঁচামারা’য়। কৃষিকাজের ছদ্মাবরণে তারা নির্বিঘ্নে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই চরটি। এসব অপরাধীর বিষয়ে অবগত রয়েছে থানা পুলিশও। তবে দুর্গম এলাকা হওয়াতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ডাকাতিসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত থাকলেও এলাকায় এসব অপরাধী সাধু সেজে থাকে বলে জানিয়েছে দৌলতপুর থানা পুলিশ।

সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা জেলার সদস্যরা একটি ডাকাতি মামলার তদন্তে নামলে তাদের অনুসন্ধানে ‘চর বাঁচামারা’ নিয়ে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ওই ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ১১ জনের ৭ জনকেই এই চর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পরই নড়েচড়ে বসে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পিবিআই বলছে, অন্তত ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই চরের গহিনে উঁচু ভিটাতে খুপরি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছে অনেক অপরাধী। এদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে। আবার অনেকে সম্প্রতি থাকা শুরু করেছে। এই দুর্গম চরের গহিনে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সেখানে অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের গ্রেপ্তার করা কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলে তারা দ্রুত সটকে পরে চরের সরু খাল দিয়ে। সেখানে থাকা ডিঙি নৌকায় নদীতে পালিয়ে যায়। এসব অপরাধীর কাছে রয়েছে দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। দুর্গম এই চরে গিয়ে আসামি ধরে আনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। 

গত বছরের ২৪ জুলাই রাতে সাভারে একদল ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হন মাইদুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী। তাকে গুরুতর জখম করে মৃত ভেবে রাস্তার পাশে ফেলে দেয় ডাকাত দল। এ ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে নামে পিবিআই। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ‘চর বাঁচামারা’ থেকে দুর্ধর্ষ ৫ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেন পিবিআই’র ঢাকা জেলার সদস্যরা। গ্রেপ্তাররা হলো সুমন মিয়া (২৫), শরীফ মোল্লা (২০), মুহিত শেখ (২২), আলমগীর হোসেন (২৮) ও রাজীব হোসেন (২১)। গার্মেন্টসের স্টাফ বাসে যাত্রী বেশে ডাকাতি করত এই চক্র। এছাড়া মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে তারা। 

পিবিআই ঢাকা জেলার এসআই সালেহ ইমরান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই ‘চর বাঁচামারা’য় অনেক অপরাধী বংশপরম্পরায় থাকে। তারা সেখানে কেউ মাছ ধরে, কৃষিকাজ করে। আর সুযোগমতো ঢাকা ও এর আশেপাশে এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে। এদের বিরুদ্ধে যখন একাধিক মামলা হয় তখন পাশের দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার আলমগীরের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও মাদকের চারটি মামলা রয়েছে। সে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।’

এই পিবিআই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘একাধিকবার অভিযান চালিয়ে এই চর থেকে অপরাধী গ্রেপ্তার করেছি। তবে তারা আমাদের যাওয়ার খবর আগেই পেয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।’

‘চর বাঁচামারা’য় অপরাধীদের ঘাঁটি গাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানার ওসি রেজাউল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিবিআই চরের মাঝখানে ছোট্ট নদীর পাড় থেকে ওই ডাকাতদের গ্রেপ্তার করেছে। চরের এই অংশটি জিয়নপুর ইউনিয়নে পড়ে। চর বাঁচামারা ও উলাইল এলাকায় থাকা এসব অপরাধী পেশাদার। তারা ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলে ডাকাতি করলেও এলাকায় সাধু সেজে থাকে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে ৫ থেকে ১০টি ডাকাতির মামলা রয়েছে। অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

সাভার থানায় ডাকাতির ঘটনায় মাইদুল ইসলামের করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ জুলাই রাত অনুমানিক ২টায় গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট যাওয়ার জন্য তিনি সাভারের হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ‘অফিস স্টাফ’ লেখা একটি বাসে ওঠেন। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাস চালকসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৭ থেকে ৮ জন লোক মাইদুলের হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। বাসের মধ্যে শুইয়ে এলোপাতাড়ি মারধর এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন সেট, কাপড়-চোপড়, নগদ টাকা ও বিকাশে থাকা টাকাসহ প্রায় ২৬ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পরে তাকে হাত-পা বেঁধে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় সাভারের তুরাগ নদীর পাড় সংলগ্ন রিকু ফিলিং স্টেশনের বিপরীত পাশে ফেলে রেখে বাস নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে সাভার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ৭/৮ জনকে আসামি করে একটি ডাকাতি মামলা করেন। মামলাটি পিবিআই স্বউদ্যোগে গ্রহণ করে। সংস্থাটির ঢাকা জেলার উপপরিদর্শক (এসআই) সালেহ ইমরানকে দেওয়া হয় তদন্তভার।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, গত ঈদুল আজহার কিছুদিন আগে এই ডাকাত দলটি গার্মেন্টসের স্টাফ বাস নিয়ে ডাকাতিতে নামে। মূলত গার্মেন্টস ছুটির পর শ্রমিকদের পৌঁছে দিয়ে মধ্যরাতে তারা এই ডাকাতির কাজটি করে। বাসটি চালাত লালন সরদার। এর আগে লালনকে গ্রেপ্তার করে তার কাছ থেকে ভুক্তভোগী মাইদুলের মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। লালনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধামরাই থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বাস এবং সহযোগী আলমগীর নামের এক ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডাকাতিতে মোট ১১ জন ডাকাত যাত্রীবেশে গাড়িতে ছিল। লালনকে গ্রেপ্তারের পর এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুসন্ধানে জানা গেছে চক্রের হোতা আলমগীর। চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে মুহিত। সে হেলপার হিসেবে গাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে গেট লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে লাইট বন্ধ করে দিত। মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল হাতিয়ে নিত আলমগীর। যাত্রীদের মারধর করে হাত-পা ও চোখ বেঁধে সাভার এলাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় ফেলে দিত তারা। তারা আরও বেশ কয়েকজন ডাকাতের নাম প্রকাশ করেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। এই ঘটনায় জড়িত আসামিদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে ছিনতাই এবং মাদক মামলার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযানে অংশ নেওয়া পিবিআই’র এক কর্মকর্তা বলেন, দৌলতপুরের আমতলী বাজার দিয়ে পায়ে হেঁটে ৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর চর বাঁচামারা। সেখানে যেতে বেশ কিছু ছোট ছোট খাল রয়েছে। কখনো সাঁকোয় আবার কখনো ডিঙি নৌকাতে পার হতে হয় সেসব খাল। চরে সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পও আছে। তবে চরের গহিনে জনমানবের উপস্থিতি কম। সেখানে উঁচু ঢিবিতে ছোট ছোট ঘর করে অনেক অপরাধী বাস করে। কৃষিকাজের আড়ালে তারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এরা বেশ প্রভাবশালীও। টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে তারা। স্থানীয়রা তাদের কাছে অনেকটা অসহায়।