• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

যেভাবে হিজরি সনের যাত্রা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২০  

ইসলামের ইতিহাসে হিজরত এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, সুদূরপ্রসারী। এটি দ্বীন ও মানবতার বৃহত্তম স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক সাহসী পদক্ষেপ। মক্কার কাফিরদের পাশবিক নির্যাতন-নিপীড়ন, অব্যাহত অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীরবে সহ্য করছিলেন মহানবী মোহাম্মদ (সা.)। তখন মহানবী (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কাফিররা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। একইসঙ্গে মহানবী (সা.) ও মক্কার মুসলমানদের মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দেন।

হিজরত এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এটির মাধ্যমেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দ্বার উন্মোচিত হয়। সশস্ত্র যুদ্ধে তাগুতি শক্তির মোকাবিলার শুভ সূচনা হয়। একইসঙ্গে মক্কা বিজয়সহ ইসলামের বিশ্বজয়ের রঙিন সূর্য উদিত হয়।

হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানান ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)। তিনি হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। প্রণয়ন করেন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চন্দ্র মাসের পঞ্জিকা।

নতুন সন গণনা প্রথা চালু নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। আল্লামা আইনি লিখেছেন, ‘হিজরি সন প্রণয়ন নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে সমরকন্দি বলেন, আবু মুসা আশআরি (রা.) ওমর (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেন যে আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে কিন্তু তাতে কোনো তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সন গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সনের গোড়াপত্তন করেন।’

আল্লামা ইবনুল আসির (রহ.) আল কামিল ফিত তারিখের মধ্যে এটিকে প্রসিদ্ধতম ও বিশুদ্ধতম অভিমত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূত্র: প্রাগুক্ত খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮)

আল্লামা আইনি তারপর লিখেন, ‘আবুল ইকজান বলেছেন, ওমর (রা.)-এর কাছে পেশ করা একটি দলিলে কেবল শাবান মাসের কথা লেখা হয়। তিনি বলেন, এটা কোন শাবান! এ বছরের শাবান, নাকি আগামী বছরের শাবান? তারপর হিজরি সন প্রবর্তন করা হয়।’

আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) এ অভিমতকে প্রাধান্য প্রদান করেন। (আল ফারুক : পৃষ্ঠা ১৯৫)

নতুন সন গণনা শুরুর পরামর্শ সভা

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তখন পরামর্শ সভার আহ্বান করেন তিনি। ওই সভায় হসাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত থেকে সন গণনার প্রস্তাব প্রদান করেন। তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সন গণনার অভিমত দেন। আলী (রা.) হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব করেন। তারপর সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।

এরপর কোন মাস থেকে সন শুরু হবে-এ নিয়ে সবার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে সন শুরুর প্রস্তাব করেন। তার যুক্তি ছিল যে রজব মাসটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমেই আসে। তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার প্রস্তাব করেন। কেননা এটি উম্মতের মাস। আলী (রা.) ও ওসমান (রা.) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন। (উমদাতুল ক্বারি : ১৭/৬৬)

বর্ষগণনা হিজরত থেকে কেন শুরু করা হলো?

মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সনগণনা শুরু করা যেত। কিন্তু বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তর আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) এভাবে দিয়েছেন: সুহাইলি (রহ.) এ বিষয়ে রহস্য উন্মোচন করে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম সন গণনার বিষয়ে সুরা তওবার ১০৮ নম্বর আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে হিজরতকে প্রাধান্য দেন। সেখানে প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। এই ‘প্রথম দিন’ ব্যাপক নয়। এটি রহস্যে আবৃত। এটি সেই দিন, যেদিন ইসলামের বিশ্বজয়ের সূচনা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদে, নির্ভয়ে নিজ প্রভুর ইবাদত করেন। মসজিদে কোবার ভিত্তি স্থাপন করেন। ফলে সন গণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম সেই দিনকেই বেছে নেন। (ফতহুল বারি : ৭/২৬৮)

তিনি আরো লিখেছেন, ‘মহানবী (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, হিজরত ও নবুয়তপ্রাপ্তি-এই চার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনা করা যেত। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই হিজরতের মাধ্যমেই সন গণনা শুরু করা হয়েছে।’ (ফতহুল বারি, প্রাগুক্ত)