• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সে নেই সে আছে ।। আফসানা বেগম

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ জুলাই ২০১৯  

নেইল পলিশের শিশি নাড়াচাড়া করার ফাঁকে দোকানের আয়নায় চোখ পড়ল। দোকানের লোকটির ঘাড়ের উপর দিয়ে অনেক চেনা মুখটা দেখে চমকে উঠলাম; সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে।

গাড়ির দুপাশের আয়নায় যেমন সমস্তকিছুকে ছোটো দেখা যায়, তাকেও ছোটো দেখাল দূরত্বের কারণে। দূরত্বই ভালো, যা আমরা দুজনে যত্ন করে বাড়িয়েছিলাম। শরীর কাঠ হয়ে গেল আমার। হাতে ক্যাটকেটে রঙের শিশি, দোকানের লোকটা উৎসুক, নেইল পলিশটা কি পছন্দ হয়েছে? আমার চোখ আয়নায়, হ্যাঁ, সে মানুষটাই! সেই চোখ, সেই মুখ, এখনো একমাথা কোঁকড়ানো চুল! ওই চুলের স্পর্শ আঙুলে চাইলে এখনো পাই, ওই চিবুক ছুঁয়ে কতদিন আমি... ‘আপা কি এইটা নিচ্ছেন?’ দোকানের লোকটার প্রশ্নে কেঁপে উঠলাম। শিশিটা কাচের উপরে বিশ্রী শব্দ করল। আয়নার মানুষটিও তাতে প্রভাবিত হলো, তার অবস্থান বদলে গেল। আয়নায় ভেসে উঠল তার সঙ্গের আরেকজন, কমনীয় প্রতিচ্ছবি, চর্চিত মুখ, হালকা রঙের পোশাকে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। হ্যাঁ, মেয়েটি তারই সঙ্গে। তাদের চোখজোড়া উঁচু তাকে কিছু খুঁজছে। দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার কেনা না-কেনা নিয়ে দোকানের লোকটির কৌতূহলের চেয়ে পিছনের আগন্তুকের প্রতি আমার কৌতূহল বড়ো হয়ে হয়ে দাঁড়াল। তারপর তার চোখ-মুখ-চিবুকের সঙ্গে স্মৃতি মিলিয়ে নেয়ার তাড়াহুড়ো উবে গিয়ে সঙ্গের মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখার আগ্রহ প্রকট হয়ে উঠল... এই তাহলে তার ভালোবাসা? এই তবে তার জীবন এখন!

সামনের লোকটি তাদের দুজনের ইশারা করা জিনিসটা উঁচু তাক থেকে নামিয়ে দিতে গেল। তাদের চোখও সেদিকে। সেই সুযোগে বেরিয়ে এলাম। ঠিক যেমন বহু বছর আগে তার কাছ থেকে ফিরে এসেছিলাম। সেদিন পিছনে ফিরে তাকাইনি কিন্তু আজ সরতে পারলাম না। উল্টোদিকের দোকানে কিছু কেনার অভিনয় করতে করতে চোরাচোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারা ভাবনায় পড়ল, কিছু একটা খুঁজে পেল, দোকানের ছেলেটা তাদের পছন্দের র‌্যাপিং পেপারে জিনিসটা মোড়াল, উপহারের পোড়ানো প্যাকেট নিয়ে কথায় আর হাসিতে ভরপুর তারা বেরিয়ে গেল। আমার অবস্থানের কথা সে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না। তবে যে একবার আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে বলেছিল চোখ বাঁধা থাকলেও আমার গন্ধের উপস্থিতি সে বলে দিতে পারবে? অহেতুক নিজের দিকে তাকালাম। হতে পারে নিজের হারিয়ে যাওয়া গন্ধ নিজেই খুঁজছি। অথচ পেলাম কেবল শরীর ভরা ঈর্ষা, তার সঙ্গের মোহনীয় নারী আমাকে এক সমুদ্র ঈর্ষায় ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল।

ছোটো ছোটো পদক্ষেপে রাস্তার দিকে এগোচ্ছি, কিন্তু কোথায় যেন কোনো এক ফাল্গুনে বাড়ির পাশের আমবাগানের আবছায়ায় তার হাত ধরে হাঁটছি, মগডালে সদ্য উঁকি দেয়া মুকুলের গন্ধ নাকে লাগছে, পায়ের নীচে কয়েকটা কড়কড়ে শুকনো পাতা মুড়মুড়ে শব্দ তুলে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে, হাতের তালুর মধ্যে হাতের তালু হারিয়ে যাচ্ছে... এক মুহূর্ত থেমে নিজেকে খানিক বকে নিলাম। আমি কি তিরিশ বছর আগে ফিরে যেতে চাই? আমার কি মাথাটা গেল! ধমকে ভিতর থেকে ঝাঁকি খেলাম। আবারো চলতে লাগলাম। কোথাও যেন গান বাজছে, মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে... গানের গলাটা আমারই মতো, আমিই গুনগুনিয়ে গাইছি। কানের খুব কাছে এসে কেউ বলছে, ‘নেই মানে? সব বসন্তে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে, নেই বললে হবে না কিন্তু।’ কণ্ঠটা তার। কথা আর গুনগুনানিতে ভরদুপুরের নিস্তব্ধতা চিরে চিরে আমরা আমবাগানের নির্জনতম অংশের দিকে ধাবমান। হঠাৎ মনে হলো গালের উপরে অশ্রুর ফোঁটা। ওড়না বুলিয়ে নিলাম। এত বছর পরে অদ্ভুত যন্ত্রণা তো! হুট করে যেন কিছু হাওয়া, যেন কেউ আমার হাত থেকে কোনো খেলনা কেড়ে নিয়েছে। মনে পড়ল তার সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যাবার ঠিক পরের দিনের ভোরবেলাটার কথা। আবছা আলোয় ঘুম ভেঙে ধড়ফর করে বিছানায় উঠে বসেছিলাম। বুকের ভেতরটা এমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল যেন আকস্মিক আমার কোনো অঙ্গহানী ঘটেছে। রাতারাতি কারো সমস্ত দাঁত মুখ থেকে উধাও হয়ে গেলে যেমন হবে, ঘুম ভেঙেই জানবে তার মুখের ভেতরটা শূন্য, ছুটে গিয়ে আয়নায় না-দেখলেও সে জানবে। আমি ঠিক সেভাবেই নিশ্চিত হয়েছিলাম, অন্তর থেকে জেনেছিলাম, সে নেই।

গালের উপরের দ্বিতীয় ফোঁটাটা ওড়নায় মুছে নিলাম। গলার কাছে কিছু আটকে থাকার তীব্রতাটা না-পারছি গিলতে না-পারছি ফেলতে। এত বছর কোথায় ছিল এসব স্মৃতি! ওর মুখটাও তো মনে পড়েনি বছরের পর বছর। চিঠি-ছবি যা ছিল বাড়ির পিছনের পুকুরে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। এতদিন বাদে এসব ফালতু আবেগের কোনো মানে হয়! ওদিকে মেয়েকে কলেজ থেকে আনতে যাব অথচ ঘড়িই দেখিনি বহুক্ষণ। বেশ দেরি করে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে কলেজ ফাঁকা, শুকনো মুখে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। গত মাসে এক সন্ধ্যায় ঘরে বাতি না-জ্বালিয়ে এরকম থম মেরে বসে ছিল। সুইচে হাত দিতেই দেখি শুকনো মুখ, হাঁটুর উপরে থুতনি ঠেকানো। কিছু না-বলে আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠেছিল আমার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ড্রাগ থেকে শুরু করে ধর্ষণ কিংবা প্রেগন্যান্সি কিছুই ভাবতে সময় লাগেনি। ফোঁপানি শেষ হলে জানা গেল প্রথম প্রেমের সমাপ্তি। আমার হাসি পেয়েছিল তখন, ‘তাই বল, আমি ভাবলাম কিনা কী!’ কান্না মুছে সে খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘আমার এই অবস্থা দেখে তুমি হাসছ, মা?’ আমি সামলে নিয়ে বলেছিলাম, ‘না রে, খুবই কষ্টের ব্যাপার, হাসব কেন? মানে, হাসছি এই ভেবে যে, যাক তেমন কিছু তো হয়নি, বাঁচা গেল।’

‘সজলের সঙ্গে আমার ব্রেকআপ, আর তুমি বলছ তেমন কিছু হয়নি?’

‘না মানে, হয়েছে, তবে সেরকম কিছু... যা হোক, শোন, মন খারাপ করিস না। এরকম হয়, ঠিক তোর বয়সে আমারো একবার...’

নিজের পুরোনো কাহিনি তখন সংক্ষেপে শুনিয়েছিলাম তাকে। চোখ গোল গোল করে আদ্যোপান্ত শুনেছিল। কখনো মনে হচ্ছিল সান্ত্বনা পেল, কখনো আবার দুঃখ দ্বিগুন হবার মতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আহা মা, তোমারও! সো স্যরি, মা।’তারপর পুরোটা শুনে হাঁ হয়ে গেল, ‘তোমাদের প্যারেন্টসের এত সময় ছিল, কোন ছেলে-মেয়ে কার সঙ্গে কোথায় প্রেম করছে, কীভাবে ছাড়াতে হবে, এত্ত কায়দা করত তারা! আশ্চর্য।’ 

কলেজের গেটে দাঁড়ানো শুকনো মুখটা দেখে মনটা কেমন করে উঠল, ‘কী রে, কী হয়েছে?’

‘কী আবার, তোমাকে বলেছি না, একা থাকলেই আমার ওসব মনে পড়ে। আসতে দেরি করলে কেন?’

‘স্যরি, মা।’

‘আর দেখ, একা হতেই ভাবলাম ফেসবুক খুলি। খুলে ভাবলাম রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটা বদলে দিই। ইন এ রিলেশনশিপ বদলে সিঙ্গেলে টিক দিতেই কোত্থেকে এসে প্রথমে লাইক দিল সজল। কেমন লাগে বলো তো, মা?’

‘এতই যদি খারাপ লাগে তো তুই ওকে ব্লক করিস না কেন?’

‘ইমপসিবল! সজলকে ব্লক করলে ও কী করে দেখবে যে আমি কত সুখে আছি? এমনি কি প্রতিদিন সেজেগুজে সেলফি আপলোড করছি আর চেকইন দিচ্ছি?’

‘হায় রে! তোর এসব ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। তুই এখনো ওর দেখাদেখি নিয়ে আছিস মানে হলো গিয়ে তুই এখনো ওকেই...’
কথাটা বলতে গিয়ে কেন যেন হুট করে থেমে যেতে হলো আমাকে। আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তুমি তবে কেন ওর কথা ওভাবে ভাবছিলে তখন? তার জীবন এখন কার সঙ্গে কাটে তা দিয়ে তোমার কী? তার জীবনসঙ্গী তোমাকে কেন ঈর্ষায় পোড়ায়? লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের হাসিঠাট্টা দেখেইবা তুমি কী পেলে? কথাগুলো শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অথচ মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, তুমুল রোদে ছায়া ছায়া, তার সুন্দর সংসার হয়েছে নিশ্চয়। সে সুখে আছে। 

‘জানি না আমি এখনো ওকেই ভাবি কি না, কিন্তু কিছু অস্বস্তি তো আছেই,’ মেয়ের কথায় ভাবনা ভেঙে গেল।
‘অস্বস্তি মানে?’

‘আরে, ওই সজল হলো গিয়ে আমার পুরোনো একটা ডায়রির মতো। যেদিন যা হয়েছে সব সেখানে লেখা হয়েছে, বুঝলে? সবকিছু জানে। আমার ভালো-খারাপ, কত কত লজ্জার কথা, উহ্!’

‘এটা একদিক দিয়ে ভালো, বুঝলি? সব জেনেও সে যদি এখন তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে তবে বলতে হবে তুই তার জন্য ভালো কিছু করেছিস।’
‘বন্ধুত্ব মাই ফুট! ওকে আমি মজা বুঝিয়ে ছাড়ব।’

‘এটা ঠিক না। একই ক্লাসে পড়িস, বন্ধু হতে অসুবিধা কী?’

‘শোনো মা, কারো এক্স যখন বলে, লেটস বি ফ্রেইন্ড, তখন আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয় কোনো কিডন্যাপার বলছে, বেবি, স্টে ইন টাচ।’

‘হা হা হা...’

‘হাসবে না তো! এক্স মানে কী জানো? যে তোমাকে এক্সপেরিয়েন্স দিয়েছে, যার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক এক্সপায়ার্ড হয়ে গেছে আর যে তোমার জীবন থেকে এক্সিট নিয়ে নিয়েছে। ওসব বন্ধুত্ব-ফন্ধুত্বের ঢং আমি করি না। আর তা ছাড়া, এক্স হলো গিয়ে একটা এক্স্যাম্পল যা জীবনে আর কখনো হওয়া উচিত না। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলে সিঙ্গেল দিয়েছি, সজল খুশি হয়েছে। যদি থাকত, নট ফলিং ফর দ্যাট শিট অ্যাগেন, তবে সেটাই দিতাম।’

মেয়েটা একদম আমার মতো হয়েছে। কোনো ভণিতা নেই। নিজের এরকম সময়টা কেবলই সামনে চলে আসছিল। শেষ দিনে সে আমাকে বলেছিল, ‘আমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া যায় না?’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘প্রত্যেকেরই জীবনে আরেকটা সুযোগ পাওয়া উচিত, তবে তা আরেকজনের সঙ্গে।’ব্যস, নিয়েছে তো সুযোগ আরেকজনের কাছে! তবে আজ আমার এত জ্বলল কেন? কখনো সবকিছু থেকেও শুধু একজনের না-থাকায় কী ভীষণ শূন্য লাগে! এতকিছু দিয়ে ভরা জীবন, এত আয়োজন, এত পরিবর্তন, শুধু স্মৃতি ধ্রুবতারার মতো স্থির। একইরকম বছরের পর বছর। যখন খুশি মেলে দেখা যায় আবার না চাইতেও কখনো ঝাঁপি খুলে গিয়ে ফণা তোলে। আমার কোনো শূন্যতা নেই, আমার জীবন পরিপূর্ণ। তবু সে কেন নেই! সে মানে আজ যাকে দোকানে দেখেছি, সে নয়। সে মানে যাকে তিরিশ বছর আগে কোনো মফস্বল শহরের কোনো নদীর কোনো ব্রিজের ধারে ফেলে চলে এসেছি। চোখ বুজলে যাকে এখনো ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই মুহূর্তে চোখ বোজা গেল না, টলটলে হয়ে ছিল।

‘শোনো, মা, আমার কথা হলো কেউ যদি তোমাকে কষ্ট দেয় তো একটা নদীর সমান কাঁদো। কাঁদতেই থাকো। তারপর সেই নদীর উপরে একটা ব্রিজ বানিয়ে গটগট করে হেঁটে পার হয়ে যাও।’

মেয়ের কথা শুনে খুব হাসলাম। সে ভাবল হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে। অথচ হাসি থামতেই আবার স্মৃতির ফণা। ভরদুপুরে কলেজ থেকে তার বাড়িতে উপস্থিত আমি। ঘরের দরজার খানিক দূর থেকে তাকে দেখলাম, পড়ার টেবিলে কাজে মগ্ন। কেন যেন হুড়মুড় করে ঢুকতে ইচ্ছে হলো না। দেখি না, একা থাকলে তাকে কেমন দেখায়! চওড়া পিলারের আড়ালে গোপনে চলল আমার গোয়েন্দাগিরি। ওদিকে মনের মধ্যে কে যেন বলে চলল, ‘কাছে যাওয়া বড্ড বেশি হবে, এই এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। তোমার ঘরে থমকে আছে দুপুর, বারান্দাতে বিকেল পড়ে এল’.. উহ্ কী হলো আজ, মেয়ের সামনে কেঁদেকেটে লজ্জায় পড়তে আর বাকি নেই।

‘এক্স হলো গিয়ে একটা স্টেপিং স্টোন, বুঝলে মা? কিন্তু তোমাকে যেতে হবে অনেক উপরে।’ ভারি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে মেয়েটা সিঁড়িগুলো পটাপট ভাঙতে লাগল। আমি পিছনে এলাম ধীরে। সিঁড়ির পাশে কাঠের কারুকাজে আয়না। আয়নায় চোখ যেতেই আমার আজকের মুখ, অচেনা বিষণ্ণতায় ছাওয়া, খামোখাই ক্লান্ত। দেখে চমকে উঠলাম। এতক্ষণ অন্য এক ‘আমি’-র মধ্যে ছিলাম। তার চোখ দিয়ে আমি আমাকে দেখছিলাম, একহারা শরীর, কোমর ছাপানো কুচকুচে কালো চুল, ভাঁজবিহীন গলা। তার চোখে কেমন ছিলাম আমি? কেমন ছিল সে সময়টা যখন কিছুই না-করে শুধু তার পাশে বসে থাকাটাকেই সবচেয়ে জরুরি কাজ বলে মনে হতো?

খাবারের টেবিলেও মেয়ের কথার ফুলঝুরি ছুটতে লাগল। ‘দাঁড়াও, ভালো একটা রিলেশনশিপ হয়ে নিক আমার, তারপর মজা দেখাব।’
‘কী করবি?’

‘আগামী বছর এগারোই জানুয়ারি আসবে না? ওটা হলো ওয়ার্ল্ড এক্স ডে।ওইদিন...’

‘এক্সদেরও আবার দিবস আছে?’

‘থাকবে না কেন! যার সঙ্গে রিলেশনশিপ হবে তার সঙ্গে সেলফি উঠিয়ে ওইদিন সজলকে পাঠাব। উইশ করব বেচারাকে, আহা।’ 
‘তুই পারিসও, বাবা।’

‘তুমি হলে কী করতে, বলো? কী করেছিলে যখন তোমার এমন হলো?’

‘কিছুই করিনি। ওই শহর থেকে চলে এসেছিলাম।’

‘ব্যস, এত্ত সহজ?’

‘এতই সহজ। আমাদের কৈশোরে সিনেমার দৃশ্য হতো এরকম, নায়ক আর নায়িকার সম্পর্ক শেষ হবার বহুবছর পরে রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে দেখা হয়েছে। নায়িকা নায়ককে বলছে, তোমার শার্টের বোতামটা ছিঁড়ে গেছে। আসলে নায়িকা ওটা সেলাই করে দিতে চাচ্ছে, আগে যেমন করত। আর নায়ক তখন মুখ গোমড়া করে বলছে, শুধু শার্টের বোতাম কেন, আমার তো সবকিছুই ছিঁড়ে গেছে। ব্যস, এটুকুই।’
‘এটুকুই? আর তোমরা তখন মনে মনে হারানো লাভারকে বহুবছর পরে দেখার কল্পনা করতে? দেখা হলে এমন কিছুই হবে বলে ভাবতে? হা হা হা...’

ভাতের থালা থেকে হাত উঠিয়ে মেয়েটা জোরে জোরে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে একসময় কাঁদতে শুরু করল। তাকে জড়িয়ে ধরলাম। যে কান্না আমি অনেকক্ষণ ধরে চেপে রেখেছিলাম কেন যেন বাধ ভাঙার মতো বেরিয়ে এল। বুঝলাম না আমি মেয়ের জন্য কাঁদছি নাকি নিজের জন্য। ফোঁপানির দমকে মেয়েটার শরীরটা ফুলে ফুলে উঠল। কান্নাজড়ানো অস্পষ্ট উচ্চারণে সে বলল, ‘আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন, মা? বুকটা এত ব্যথা করছে কেন?’ মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। একদম ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস। শুধু সময়, সময়টা যেতে দে। একসময় ভুলে যাবি। তারপর বহুদিন পরে কখনো মনে পড়বে, কিছুক্ষণ বুকের মধ্যে ঠিক এরকমই তীব্র কষ্ট হবে। খানিক পরে দেখবি আবার সব ঠিক। ভালোবাসার চেয়ে বেশি কষ্ট অন্য কিছুতে নেই রে। আবার এর চেয়ে বেশি আনন্দও যে নেই কিছুতে!’

‘আমাকে ঠিক করে দাও, মা। কেন সজলের সঙ্গে দেখা হলো আমার? কেন?’

আমিও তখন মনে মনে বললাম, কেন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার? আজইবা কেন দেখা হলো আবার? কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি ততক্ষণে স্থির, শান্ত। মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললাম, ‘শোন, জীবনে প্রত্যেকটা মানুষ আসার নির্দিষ্ট কারণ আছে। কেউ আসবে তোকে দেখতে, কেউ তোর কাছ থেকে কেবল সুবিধা আদায় করে চলে যাবে, কেউ তোকে এমন কিছু শেখাবে যা না জানলে তোর জীবন অপূর্ণ, আবার কেউ তোকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নেবে যা এমনিতে তোর পক্ষে হয়ত সম্ভব হতো না।’

‘কিন্তু আমি ওকে ভুলে যেতে চাই, মা। পারছি না কেন?’

‘কী করে ভুলবি, বোকা মেয়ে, যার সঙ্গে মনে রাখার মতো এতকিছু হয়ে গেছে? তার চেয়ে মনে রাখ, মায়াটুকু রাখ, থাক না সে তোর স্মৃতিতে কোথাও! দেখবি একসময় মানুষটা ঝাপসা হয়ে গেছে কিন্তু স্মৃতিগুলো স্পষ্ট। বুকের মাঝখানে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে তখন অবাক হয়ে ভাববি, তোর অভাব আসলে মানুষটার নাকি ফেলে আসা সময়টার!’

মেয়েটার ফোঁপানি একসময় কমে এল। আত্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কথাগুলো নিজেকেই বলছিলাম কি?