• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্বাবলম্বী হচ্ছে নারী

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২১  

শরিফা শবনমের জীবনের গল্পটা একটু অন্য রকম। স্বামী আবীর হোসেন চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, বেতনও পেতেন বেশ ভালো। বেশ সুখের সংসারই ছিল তাদের। কিন্তু ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুতে। দুই সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন তিনি। কী করবেন, কোথায় যাবেনÑ এসব ভাবতেই কেটে গেছে ৬ মাস। জীবনের ওপর দিয়ে বড় ঝড় বয়ে গেলেও দমে যাননি তিনি। টুকটাক বুটিকের কাজ জানতেন। চিন্তা করলেন এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে যদি কিছু করা যায়। তিনি আর বসে থাকেননি, মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের জয়িতা ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে মেয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে দেন ‘স্নেহা বুটিক হাউন’। শুরুতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হলেও শবনমকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। নিজের মেধা-শ্রম দিয়ে নারী হয়েও তিনি আজ স্বাবলম্বী।
কেবল শরিফা শবনম নন, তার মতো লাখো নারী আজ সফল উদ্যোক্তার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত নারী থেকে আজ তারা স্বাবলম্বী নারীতে পরিণত হয়েছেন। গড়ে তুলছেন শিল্প কারখানা, কর্মসংস্থান করছেন লাখ লাখ বেকারের। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।


এমন অসংখ্য জয়িতা এখন দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে তুলছেন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। অবশ্য অধিকাংশ উদ্যোক্তাকেই প্রতিষ্ঠা পেতে হচ্ছে নানা বাধা অতিক্রম করে, পথের কাঁটা সরিয়ে।
এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট উদ্যোক্তার ৩১.৬ শতাংশই নারী। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই কাজ করে এ দেশের নারীরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছেন। জরিপের ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, উগান্ডায় নারী উদ্যোক্তা ৩৪.৮ শতাংশ, বাংলাদেশে ৩১.৬ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৩১.৪ শতাংশ। স্বল্প আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোয় নারীরা ব্যবসার সুযোগ পেয়ে নয়, মূলত প্রয়োজনের তাগিদেই উদ্যোক্তা হন। তাই ব্যবসার যে কোনো ধরনের সুযোগ পেলেই এসব নারী সেটি কাজে লাগান।
উইমেন এন্টারপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বলেন, নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে এক সময় বড় বাধা ছিল পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। শুরুতেই বাধা আসত পরিবার থেকে। একজন মেয়ে হয়ে ব্যবসা করবেÑ এটা পরিবারের কোনো সদস্যই মেনে নিতে পারত না। তা ছাড়া সমাজও ভালো চোখে দেখত না। আশার কথা হচ্ছে, সে অবস্থার এখন পরিবর্তন হয়েছে। নারীর উদ্যোক্তা হতে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা এখন তেমন একটি নেই। এখন বড় সমস্যা অর্থনৈতিক সঙ্কট। নারীরা মূলত পরিবারে তার স্বামী বা বাবার ওপর নির্ভরশীল। নিজের তেমন পুঁজি থাকে না। তাই কোনো নারী উদ্যোক্তা হতে চাইলে অর্থের জোগান করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যাংকগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত না এবং সকলে সহজে ঋণ পান না। তবে শত বাধা উপেক্ষা করে বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছেÑ এটা বড়ই স্বস্তির বিষয়। কারণ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অর্ধেক জনসংখ্যাকে চার দেয়ালে বন্দি করে রেখে কখনই দেশের উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে নারীকে স্বাবলম্বী হতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, নারীদের সহজ শর্তে চার থেকে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হলে তারা সফলভাবে বিনিয়োগে আসতে পারেন। কিন্তু ব্যাংক ঋণ পেতে নারীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। নারী উদ্যোক্তারা যাতে সহজেই ব্যাংক ঋণ পেতে পারেন, সে জন্য তাদের জন্য একটি পৃথক ব্যাংক গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। ২০০৫ সালে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হলেও তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন সময় এসেছে সরকারের এ বিষয়ে ভাববার।


দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি অনেকগুলো সংস্থা ও সংগঠন কাজ করছে। বেসরকারি পর্যায়ে উইমেন এন্টাপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, উইমেন চেম্বার নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে। সরকারি পর্যায়ে এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক কিছু কাজ করছে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে। তবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদফরের জয়িতা ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জয়িতা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮০টি সমিতির মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে বুটিক, বিউটি পার্লার, খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলছে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের।
এ বিষয়ে জয়িতা ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খান সময়ের আলোকে বলেন, জয়িতা ফাউন্ডেশন নিজে ব্যবসা করে না, নারী উদ্যোক্তারা এখানে জয়িতার প্লাটফর্মে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করেন। জয়িতা ফাউন্ডেশন পরিকাঠামোগত সুবিধাদিসহ নারী উদ্যোক্তাদেরকে ব্যবসা পরিচালনায় ও পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-দক্ষতা প্রদান করে। ক্ষেত্রবিশেষে পুঁজি জোগানের ক্ষেত্রে ঋণ সহায়তা প্রদান করে। জয়িতার ব্র্যান্ড ভ্যালু সৃষ্টির লক্ষ্যে বিপণনযোগ্য পণ্য বা সেবার মান নিয়ন্ত্রণসহ প্রচার-প্রসারে জয়িতা ফাউন্ডেশন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে। কোন ব্যক্তি নারী উদ্যোক্তা নয়; সমিতিতে সংগঠিত নারী উদ্যোক্তারা উৎপাদিত পণ্য এক ছাদের নিচে সমিতিভিত্তিক আলাদা আলাদা স্টলে জয়িতার ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে। জয়িতা ফাউন্ডেশন ব্যবসা অনুকূল ও নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করে। নারী উদ্যোক্তা সমিতির সদস্যগণ ব্যবসায় অর্জিত মুনাফা স্ব স্ব অবদান অনুসারে প্রাপ্য হন। অন্যান্য প্রতিযোগীদের উপস্থিতিতে একটি বাজার ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তাগণ তাদের ব্যবসার সবল-দূর্বল দিক এবং সমস্যা-সম্ভাবনার দিকগুলি অনুধাবন করে তাদের ব্যবসা কার্যকরভাবে পরিচালনায় সব সময় সচেষ্ট জয়িতা ফাউন্ডেশন।
এদিকে মহামারি করোনার মাঝেও অনেক নারী উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। নারীরা ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমেও ব্যবসা চালাচ্ছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে ফেসবুক পেজ খুলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করছেন নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্য। চলমান করোনার মধ্যে অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা অনেক সৃষ্টি হয়েছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঈদসহ যেকোনো উৎসবে এ লেনদেন বাড়ে। নারী উদ্যোক্তাদের কেউ পোশাক, কেউ গয়না, কেউ হাতে তৈরি জিনিস, কেউ তৈরি খাবারসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কেউ শৌখিন পণ্য নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। এই নারীরা শিক্ষিত। সংসারের চাপসহ নানা সমস্যায় অনেকের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। অনেকে নিজে কিছু করবেন বলে বদ্ধপরিকর। ফলে সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বাধীন এ ব্যবসায় আগ্রহ বাড়ছে নারীদের।
করোনা মহামারির শুরু থেকে অনেক বেশি নারী সম্পৃক্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে। অনলাইনে দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে উই উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। উই গ্রুপের কল্যাণে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে হাজারো নারী। উইএর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ফেসবুক ভিত্তিক এই প্ল্যাটফর্ম উই এখন দশ লাখ সদস্যের পরিবার। যাদের প্রায় সবাই দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা। নিজেদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়। ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে নারীরা আরও বেশি করে এগিয়ে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শুধু অনলাইন বা শহর কেন্দ্রীক নয়, গ্রামীন অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছেন নারীরা। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও অনেক নারীর উদ্যোক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন। বর্তমানে জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশের কিছুটা বেশি। কিন্তু বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অবদান স্বীকার করলে এই হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। বর্তমানে কৃষি খাতে নিয়োজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডব্লিউসিসিআই) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সেলিমা আহমাদ এমপি বলেন, নারীরা এখন সব পর্যায়ে এগিয়ে আসছে। ব্যাবসা-বাণিজ্যে নারীর অবদান বাড়ছে। তবে নারী যাতে সহজে উদ্যোক্তা হতে পারেন, তার জন্য সবার আগে ঋণ প্রাপ্তি সহজ করতে হবে। কারণ ঋণ পেতে এখন নারী উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক বাধা এখন আর নেই, আর্থিক বাধা কেটে গেলে নারীরাই বদলে দিতে পারবে দেশের অর্থনীতির চিত্র।