• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ঢাকায় সক্রিয় শতাধিক গাড়ি চোর চক্র

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২১  

ঢাকায় গাড়ির চোরের উৎপাত বেড়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে চুরি হচ্ছে ছোট বড় গাড়ি। চুরি হওয়া এসব গাড়ি উদ্ধারের ঘটনা খুবই কম। গাড়ি চুরির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়াতে মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চুরি হওয়া গাড়ি ফিরে পাওয়ার জন্য অনেক মালিকরা পুলিশ ও ডিবির কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ ফিরে পাচ্ছেন আবার কেউ পাচ্ছেন না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হিসাবেই ঢাকা ও আশপাশের জেলায় শতাধিক গাড়ি চোর চক্র রয়েছে। ডিবির অভিযানে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন চক্রের হোতাসহ অন্যান্য সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়।

গত ২১ মাসে ডিবি ২৬২ গাড়ি চোরকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় মামলা হয়েছে ৫৯০টি। উদ্ধার করা হয়েছে ৪৯৬টি চোরাই গাড়ি। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর গাড়ি চোর গ্রেপ্তার ও চোরাই গাড়ি উদ্ধার কম হয়েছে। তবে গাড়ি চুরি হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকরা মামলা করেন না। চোরের সঙ্গে সমঝোতা করে গাড়ি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সসূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ঢাকায় গাড়ি চুরির মামলা হয়েছে ৩৩২টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৬২ জনকে। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩৭টি মামলায় ৯ জন গ্রেপ্তার। ৫২টি গাড়ি উদ্ধার। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ মামলায় ১৮ জন গ্রেপ্তার। ৩৭টি গাড়ি উদ্ধার। মার্চ মাসে ৩৭ মামলায় ২৫ জন গ্রেপ্তার। ৫৮টি গাড়ি উদ্ধার। এপ্রিল ও মে মাসে ১১টি মামলা হলেও কোনো গ্রেপ্তার নেই। ১৩টি গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। জুন মাসে ২৯ মামলায় ১৫ জন গ্রেপ্তার। ২৯টি গাড়ি উদ্ধার। জুলাই মাসে ২৩ মামলায় ১৩ জন গ্রেপ্তার। ৩৩টি গাড়ি উদ্ধার। আগস্ট মাসে ৩০ মামলায় ১৩ জন গ্রেপ্তার। ৩২টি গাড়ি উদ্ধার। সেপ্টেম্বর মাসে ৪৯টি মামলায় ১৫ জন গ্রেপ্তার। ৫৩টি গাড়ি উদ্ধার। অক্টোবর মাসে ৩৫টি মামলায় ১৩ জন গ্রেপ্তার। ৫০টি গাড়ি উদ্ধার। নভেম্বর মাসে ২৯টি মামলায় ২৮ জন গ্রেপ্তার। ২৫টি গাড়ি উদ্ধার। এবং ডিসেম্বর মাসে ২২ মামলায় ১৩ জন গাড়ি চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১৬টি গাড়ি।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ঢাকায় গাড়ি চুরির মামলা হয়েছে ২৫৮টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০০ আসামিকে। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ২৯ মামলায় ১৫ জন গ্রেপ্তার। ১২টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩২ মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ জন। ১৪টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। মার্চ মাসে ২২ মামলায় ৫ জন গ্রেপ্তার। ৯টি গাড়ি উদ্ধার। এপ্রিল মাসে ৩২ মামলায় ৯ জন গ্রেপ্তার। ৮টি গাড়ি উদ্ধার। মে মাসে ৩২ মামলায় ৬ জন গ্রেপ্তার। ৮টি গাড়ি উদ্ধার। জুন মাসে ৩৩ মামলায় ৬ জন গ্রেপ্তার। ৭টি গাড়ি উদ্ধার। জুলাই মাসে ২১টি মামলায় ৭ জন গ্রেপ্তার। ১৩টি গাড়ি উদ্ধার। আগস্ট মাসে ৩৩ মামলায় ২০ জন গ্রেপ্তার। ১১টি গাড়ি উদ্ধার। সেপ্টেম্বর মাসে ২৪ মামলায় ১৮ জন আসামি গ্রেপ্তার। ১৬টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা গাড়ির মধ্যে মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে প্রাইভেটকার, জিপ, পিকআপ, বেবি ট্যাক্সি, সিএনজি, মাইক্রোবাস, বাস, ট্রাক, লেগুনা, টেম্পু, অটোরিকশা, কাভার্ডভ্যান রয়েছে।

চলতি বছরের মে মাসে ডিবির লালবাগ টিম গাড়ি চোর চক্রের বড় এক হোতাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তার নাম রফিকুল ইসলাম। এই চোরের গাড়ি চুরির দশ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল। সে চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করেছে দেশের ডজনখানেক গাড়ি চোর চক্রে। সব অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিজেই একটি বড় চক্র গড়ে তুলেছিল। রফিক নিজে যেমন ধুরন্ধর ছিল তার চক্রের সদস্যরাও ধুরন্ধর। সে নিজে এবং তার নেতৃত্বে হাজারখানেক গাড়ি চুরি হয়েছে। 

তার বিরুদ্ধে সাভার, গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও ঢাকার খিলগাঁও থানায় ৯টি মামলা রয়েছে।

ডিবি’র লালবাগ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকা, গাজীপুর, যশোর, নরসিংদী ও গোপালগঞ্জ জেলায় অভিযান চালিয়ে মূলহোতা রফিকুলসহ গাড়ি চোর চক্রের মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ সময় তাদের হেফাজত হতে চোরাইকৃত ২টি প্রাইভেটকার, ৮টি মোটরসাইকেল ও ৪টি সিএনজি উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিবি জানিয়েছে, ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলায় গাড়ি চুরির শতাধিক চক্র রয়েছে। এসব চক্র ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাড়ি চুরি করে। দেশের কমবেশি সব জেলায় তাদের সদস্য রয়েছে। এক জেলা থেকে গাড়ি চুরি করে সেগুলো অন্য জেলায় পাঠিয়ে দেয়। সুবিধাজনক স্থানে রেখে পরে বিক্রি করে। চুরি করা গাড়ি তারা ঘষামাজা করে চেচিস নম্বর, রেজিস্টেশন নম্বর পরিবর্তন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করে দেয়। আবার অনেক সময় গাড়ির পার্টস খুলে বিক্রি করে।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটা গাড়ি চোর চক্রে একাধিক সদস্য থাকে। চক্রের মূলহোতা থাকে একজন। এই হোতা চক্রের সদস্যদের আলাদা আলাদা দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া থাকে রেকি করার। তারা পুরো ঢাকা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন মার্কেট, অফিস বা বাসার সামনে রাখা গাড়ি দেখে রেকি করে। ওই সকল স্থানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন। চালক গাড়ি রেখে কোথায় যায়, কতক্ষণ থাকে। গাড়ি চুরি করে সহজে কোন রাস্তা থেকে পালানো যাবে। পুলিশের কাছে ধরাপড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সব বিষয় ভালোভাবে পরিকল্পনা করে নেয়। তারপর চুরি করার দিন চক্রের দক্ষ সদস্যকে নকল চাবি দিয়ে পাঠানো হয়। সে ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি বুঝে সুবিধামত সময়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে গাড়ি স্টার্ট করে পালায়। এ সময় তার আশপাশে চক্রের অন্য সদস্যরা তাকে নজরদারি করে। পুলিশ আসছে কিনা বা যে গাড়ি স্টার্ট করে নিয়ে যাচ্ছে তাকে কেউ দেখছে কিনা। পরে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় চক্রের সদস্যরা পেছনে পেছনে মোটরসাইকেলে করে পাহারা দেয়। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পর গাড়ির চালক বদলি হয়। নতুন চালক গাড়ি ঢাকার বাইরে তাদের চোরাই গাড়ি রাখার নিরাপদ গ্যারেজে নিয়ে যায়। এই কৌশল ছাড়া আরেকটি কৌশলে চোররা গাড়ি চুরি করে। এক্ষেত্রে চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী বেশে দাঁড়িয়ে থাকে। পরিকল্পনামাফিক তারা সিএনজি অথবা মাইক্রো ভাড়া করে দূরে কোথাও নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় চক্রের সদস্যরা চালকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেই সুযোগে তারা চালককে চেতনানাশক দ্রব্য কৌশলে খাইয়ে দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন চালক নিস্তেজ হতে থাকে তখন চক্রের সদস্যরা চালককে গাড়ি থেকে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে পালায়। অনেক সময় চালককে নিস্তেজ করতে না পারলে নির্জন স্থানে গিয়ে চালককে মারধর করে নামিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।  

ডিবি জানায়, থানায় গাড়ি চুরির যতটা মামলা হয় তার চেয়ে বেশি চুরির ঘটনা ঘটে। কারণ গাড়ির মালিকরা মামলা করতে ভয় পায়। কারণ তারা মনে করে মামলা করলে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। থানা থেকে শুরু করে তদন্ত কর্মকর্তাসহ আদালত পর্যন্ত হাজির হতে হয়। অনেক সময় চুরি হওয়া গাড়ির কোনো হদিস মিলে না। তাই গাড়ি চুরি হলে তারা অপেক্ষায় থাকে টাকা চেয়ে চোর কখন ফোন দিবে। চোর ফোন দিলে একটা দরদাম ঠিক করে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে গাড়ি ফিরিয়ে আনে। এসব কারণে বছরে কি পরিমাণ গাড়ি চুরি আর মামলা হয় তার কোনো হিসাব নাই। মামলা চেয়ে প্রকৃত চুরির ঘটনা আরও বেশি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম  বলেন, গাড়ি চুরির চেয়ে ঢাকায় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা বেশি। কারণ মোটরসাইকেল খুব সহজেই চুরি করে নিয়ে সহজে বিক্রিও করা যায়। চুরি করা মোটরসাইকেল ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বিক্রি হয়। কারণ ওই শহরগুলোতে রেজিস্ট্রেশন বিহীন মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে। যদি জেলা ও উপজেলা শহরে রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয় তবে চুরির ঘটনা কমে যাবে। তিনি বলেন, এর বাইরে প্রাইভেটকারসহ আরও কিছু গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটে। আমরা তাদেরও বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করি। চুরি হওয়া গাড়ি উদ্ধার করি। চুরি ঠেকাতে চালক ও মালিকদের সচেতন হতে হবে। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় শতাধিক গাড়ি চোর চক্র রয়েছে বলে জানান এই ডিবি কর্মকর্তা।