• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মানিকগঞ্জের বেত শিল্প বিলুপ্তির পথে!

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯  

দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মানিকগঞ্জের বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বাজারে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও স্টিলের তৈরি পণ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ এ দুই পণ্য

লতাপাতা আর সবুজ শ্যামলে ভরপুর ছিল মানিকঞ্জ ঘিওর উপজেলার প্রতিটি গ্রাম। পথ ঘাট প্রান্তর ও লোকালয় কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য আজ হুমকীর মুখে এখন আর আগের মতো বেত গাছ গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় না মূল্যবান সম্পদ বেত ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আর এর খেসারত চরমভাবে দিচ্ছেন বেত শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পীরা ফলে তারা হতাশ হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন

ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া, গোয়ালডাঙ্গী, জাবরা, তরা (মির্জাপুর), কেল্লাই, উভাজানী এলাকার বংশ পরম্পরায় বাঁশ ও বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগই পরিবারের সদস্যরাই পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বরটিয় ইউনিয়নের উত্তর শ্রীবাড়ী ঋষিপাড়া গ্রামের ১২০-১৩০টি পরিবার এখনো বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি উন্নতমানের খোল, ধামা, কাঠা, রিং, সেলেন্ডার, ফুটকাপ, টিফিনকির, নৌকা বাসকেট, সেড, পালা দাঁড়ি, টুড়ি, কুলা, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, চাটাই মোড়া, খালোই, টুরকি, চেয়ারসহ হরেক রকমের নিত্য নতুন প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী তৈরি করে থাকেন যা জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করে থাকে এমনকি এ অঞ্চলের তৈরি এসব কুটির শিল্প সামগ্রী রাজধানী ঢাকা হয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে যাচ্ছে

মানিকগঞ্জে ঐতিহ্যেবাহী ঘিওর হাটে বেত শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। এক সময় এ হাটে বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাক বোঝাই বেত বিক্রি হতো বেত কিনতে হয় পুন হিসেবে ৮০ টি বেতে এক পুন যা কিনতে হয় ১২০০-৩০০ টাকায় এ শিল্পের সঙ্গে যেসব শ্রমিক জড়িত তারা আজ পেশা পাল্টাতে শুরু করেছেন

শ্রীবাড়ী ঋষিপাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ চন্দ্র সরকার জানান, একসময় তাদের কাছে ১০-১২ জন করে বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগর ছিল তখনকার দিনে একজন কারিগরের বেতন ছিল প্রতিদিন ১০০-১২০ টাকা এখনকার দিনে সে কারিগরদের বেতন দিতে হয় ২৫০ থেকে ৩শ’ টাকা তাও সিজনের সময় পাওয়া যায় না তিনি জানান, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে

আগে একটি বাঁশের দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা, সেখানে এখন প্রতিটি বাঁশ কিনতে ১৫০ থেকে ২শ’ টাকায় আর নির্বিচারে বন জঙ্গল উজাড় হওয়ার ফলে বেত গাছ এখন খুব একটা চোখে পড়ে না তাই এ শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলো আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে বলে জানান আরেক বেত কারিগর অরুণ বিশ্বাস।

উপজেলার গোয়ালডাঙ্গী এলাকার সৈয়দ আলী কয়েক বছর হলো পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে এখন দিন মজুরি করছেন। তিনি বলেনবেত শিল্পে টাকা বিনিয়োগ করে খুব একটা লাভ হতো না এখন গতর খেটে কাজ করি, দিন বাদে ২/৩শ’ টাকা রোজগার হয় পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ে চলছি তবে যেদিন কাজ না থাকে সেদিন অনেক কষ্ট হয় তবে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি

কৃষি ও কুটির শিল্প উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক মো. নজরুল ইসলাম জানান, বাঁশ ও বেত শিল্পের জিনিসপত্রের দামের তুলনায় প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসের দাম খুব কম বাঁশ দিয়ে মোড়া তৈরি করতে যে খরচ হয় তার চেয়ে কম টাকায় প্লাস্টিকের মোড়া পাওয়া যায় আগে বেতের তৈরি দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করা হতো ডিজিটাল মাপের মেশিন আসায় দাঁড়ি পাল্লার কদর শূন্যের কোঠায় এখন একমাত্র বৈশাখী শাড়ি, পাঞ্জাবী আর গেঞ্জিতে আর্ট করা স্মৃতিগুলো দেখা যায় বৈশাখ মাসের কোনো কোনো গ্রামীণ  উৎসব বা মেলাতেও বাঁশ বেতজাত শিল্পীদের তৈরি চাটাই, কুলা, মোড়া, টোপা চোখে পড়ে খুব দৈবাৎ

তৃণমুলে বিদ্যুযেমন হাতপাখার চাহিদা কমিয়েছে, তেমনি মৎস্য শিকার, চাষাবাদ, ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র সকল ক্ষেত্রেই কমেছে বাঁশ আর বেত জাতীয় হস্ত শিল্পের কদর ৯০ দশকের পর থেকে ধীর গতিতে কমে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীগুলো আগামী দশকে হয়তোবা শুধুমাত্র স্মৃতি হিসাবেই রয়ে যাবে

ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা খন্দকার বলেন, ক্ষুদ্র শিল্প ও কুটির শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গরা আছেন তাদের যদি ঋণ এর প্রয়োজন হয় সহজ শর্তে তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ এর ব্যবস্থা করবো, যাতে তাদের আত্মসামাজিক উন্নয়ন ঘটে