• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ওরা এলো দেশ হলো স্বপ্নপুরী

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২  

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের প্রধান ফটকে প্রস্তুত ছাদখোলা সুসজ্জিত বাসটি। পুরো বাস ছেয়ে ফেলা হয়েছে নারী ফুটবলারদের পোস্টার-ব্যানারে। এই বাসে করেই হবে সাবিনা-সানজিদাদের চ্যাম্পিয়নস প্যারেড।

মিডিয়া ও ফেইসবুকের মাধ্যমে এই বাসের গল্পটা নিশ্চয় সবারই জানা। তাই এই বাসকে ঘিরে আগ্রহীর কমতি নেই বিমানবন্দরে। নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভিআইপি ফটকের সামনে উপস্থিত কয়েকশ’ ফুটবলপ্রেমী। সাভার বিকেএসপির একঝাঁক ছাত্রছাত্রীও অভিনন্দনবার্তা নিয়ে উপস্থিত। ক্রিকেটের গ্যালারি জাগিয়ে রাখা টাইগার শোয়েবও আছেন সহজাত বাঘের রূপ ধারণ করে। এর সঙ্গে বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মী আর ইউটিউবারদের ইতিউতি দৌড়ঝাঁপ। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তাদের মধ্যেও অস্থিরতা। কখন দেখা মিলে সোনার মেয়েদের। কখন সাফজয়ী বীর ফুটবলাররা ছাদখোলা বাসে উঠে উঁচিয়ে ধরবেন মর্যাদার শিরোপা।

কাঠমান্ডু থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটির ঢাকার রানওয়ে ছুঁয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগে, ১টা ৪৫ মিনিটে। এর সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে ভিআইপি লাউঞ্জের ব্যস্ততা। বাংলাদেশ বিমানের ক্রুদের সঙ্গে কেক কেটে শুরু দেশে ফেরার স্মরণীয় পর্বের। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সাড়ার পর ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ফুলের মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেন ফুটবলার, কোচ, কর্মকর্তাদের। বিমানবন্দরেই হওয়ার কথা ছিল সংক্ষিপ্ত সম্মেলনের। শুরুতে সেটা হয়নি মিডিয়াকর্মী ও ইউটিউবারদের চাপ সামলাতে না পেরে। পরে অবশ্য খানিকক্ষণ কথা বলেছেন অধিনায়ক সাবিনা ও কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। এর পরের চ্যালেঞ্জটা ছিল ভিড় ঠেলে কাক্সিক্ষত ছাদখোলা বাস পর্যন্ত পৌঁছানো। তাই বাস ছাড়তে লেগে যায় বিকেল সাড়ে ৩টা। পরের চার ঘণ্টা সাফ বিজয়ী মেয়েদের জন্য এসেছে অবিশ্বাস্য এক অভিজ্ঞতা নিয়ে। 

বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল ফুটবল ভবন এই ১৩ কিলোমিটার পথ যেখান পার হতে বড়জোর এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে লেগেছে চার ঘণ্টারও বেশি। নাহ, ঢাকার চিরাচরিত যানজট চ্যাম্পিয়নস প্যারেড আগলে দাঁড়ায়নি। বরং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ফুটবলারদের পথটা ঝামেলামুক্ত রাখার সব উদ্যোগই নিয়েছিল। তবে রাজপথে হাজার হাজার মানুষের ঢল তো আর রোখা যায় না। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সাফ শিরোপা জেতা নারী ফুটবলারদের অভিবাদন জানাতে কাল ঢাকার রাজপথ রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে। সব শ্রেণি, সব বয়সের নারী-পুরুষ কোনো বাধাই মানেননি। আলোচিত ছাদখোলা বাসের একেবারে কাছে পৌঁছতে তাদের আগ্রহের কমতি ছিল না। 

মোড়ে মোড়ে জাতীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে তাদের সরব উপস্থিতিই আরেকবার বুঝিয়ে দিয়েছে ফুটবলটা এ অঞ্চলের মানুষ এখনো কতটা ভালোবাসে। একটা সাফল্যের অপেক্ষা যদি হয় দুই শতাব্দীর, সেই সাফল্যটা যদি আসে বিদেশের মাটি থেকে এবং একঝাঁক অদম্য নারীর পায়ের ঝলকে, তখন তো কথাই নেই। ফিফা র‌্যাংকিংয়ের দুর্দশা এই মানুষগুলোর মনে স্থান পায়নি কাল। দীর্ঘদিন ফুটবলে গর্ব করার মতো ঘটনা নেই বলেই নারী ফুটবলারদের এই সাফল্যকে নিজেদের বড় প্রাপ্তি হিসেবে নিয়েই তারা নেমে এসেছিল রাজপথে। দূর থেকে হাত নেড়ে, ফুল ছিটিয়ে, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগানে মুখরিত করে তারা ফুটবলারদের জানিয়েছে অকুণ্ঠ ভালোবাসা।

দীর্ঘ পথ শম্বুক গতিতে পেরিয়েও এক রত্তি বিরক্ত হননি ফুটবলাররা। বরং মানুষের বাঁধভাঙা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অভিভূত হয়েছেন বিজয়িনীরা। পুরো পথ জুড়ে ভালোবাসার জবাবে হাত নেড়ে গেছেন, তুলে ধরে রেখেছেন পরম কাক্সিক্ষত শিরোপা।

অথচ এই দিনটি এত দ্রুত চলে আসবে এমনটা অনেকেই ভাবেননি। এতদিন বয়সভিত্তিক ফুটবলে সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়ে এলেও শীর্ষ পর্যায়ে ঠিক হয়ে উঠছিল না। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখা মারিয়া, সানজিদা, কৃষ্ণাদের শীর্ষ পর্যায়ে সাফল্য পেতে আরও সময় লাগবে এমন ধারণা ছিল খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনেরও। অথচ গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা যেন অসম্ভবকেই সম্ভব করে ছিনিয়ে এনেছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব।

বীর ফুটবলারদের নিয়ে বাসটি যখন কাকলীর মোড় পার হচ্ছিল, তখন ফুটপাতের শত শত মানুষের ভিড়ে দেখা গেল এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে। লাল-সবুজ পতাকা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলেন সারা শরীর। নিজের গর্ভে সযত্নে বেড়ে ওঠা সন্তানের কাছে বীর-দর্শনের স্মরণীয় গল্পটা একদিন গর্ব ভরে বলার সুযোগটা হয়তো হারাতে চাননি এই মা।