• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সেলুনের ভেতর পাঠাগার, একসঙ্গে চুলকাটা ও বইপড়া!

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১ জুন ২০১৯  

ভাবতেই অবাক লাগে, সেলুনের ভেতর চুলকাটা ও বইপড়ার সুযোগ রয়েছে। খটকা লাগতেই পারে। একটু স্পষ্ট করে বলি, গ্রামের অতি সাধারণ মানের একটি সেলুন। সেখানেই একই সঙ্গে চুল কাটা ও বই পড়ার সুযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলুনের ভেতরে রয়েছি বইয়ের সেলফ। প্রায় চারশ বই রয়েছে তাতে। এই দোকানে খরিদ্দার হিসেবে যারা আসেন, তারা তো বটেই, অন্যরাও বইয়ের টানে এখানে আসেন। ভেতরে বসে বই পড়েন। অনেকে আবার বাড়িতেও নিয়ে যান বই।

খুলনার বটিয়াঘাটা বাজারের এই ব্যতিক্রমী সেলুনটি রয়েছে। দোকানের মালিক মিলন শীল নিজের আগ্রহে সেলুনেই গড়ে তুলেছেন পাঠাগারটি। সেলুন চালানো আর বইপড়ার পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছেন মিলন।

মিলন শীলের সঙ্গে কথা বলে ‍জানা যায়, তার বাবা জীবিকার তাগিদে এই সেলুনটি মাত্র ১৩  বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মিলনও বাবার হাত ধরে এই দোকানে হাজির হন। পাশের হেতালবুনিয়া গ্রাম থেকে  প্রতিদিন দোকানে আসেন। শিশু বয়সেই রোজগারের জন্য নেমে পড়ায় মিলনের লেখাপড়ার তেমন সুযোগ হয়নি। আবার লেখাপড়া করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রবল। বয়সীরা দোকানে এসে শিশুটির কাজ করা দেখে আক্ষেপ করতেন। এসব দেখে-শুনে মিলনের মধ্যে লেখাপড়ার আগ্রহ তৈরি হয়।

প্রথম দিকে খবরের কাগজ রাখা হতো সেলুনে। মিলন সুযোগ পেলেই তাই পড়তেন। মাত্র চতুর্থ শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করা মিলনের পড়াটা ঠিক আয়ত্বে ছিল না। বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় তিনি পড়াটা আয়ত্বে আনেন। আচমকা একটি ঘটনা ঘটে।

একদিন এক খরিদ্দার দোকানে একটি বই নিয়ে আসেন। দোকানে অপেক্ষারত অবস্থায় তিনি বইটি পড়ছিলেন। পরে বইটি ভুলে সেলুনে ফেলেই চলে যান। মিলন পরম মমতায় বইটি হাতে তুলে নেন। পড়তে শুরু করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মেজদিদি উপন্যাসটি। বইটি তিনি একবার নয়, তিনবার পড়েন। বইয়ের কাহিনীতে তিনি আবেগাপ্লুত হন। চোখের কোণ ভিজে যায়। এ থেকেই মিলনের শুরু হয় বইয়ের প্রতি দুর্বার এক আকর্ষণ।

এর পর থেকেই মিলন বই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। নিজে পড়েন, অন্যদের পড়তে বলতেন। ধীরে ধীরে বইও সংগ্রহ বাড়তে থাকে। বাড়িতেই বইগুলো ছিল। সেখান থেকে বন্ধুরা বই নিয়ে অনেক সময় ফেরত দিতেন না। এতে মন খারাপ হতো। আবার ভালোও লাগতো, তারাতো বই পড়ছে। একসময়ে এক বন্ধু তাকে একটি মিটসেফ দেন। সেই মিটসেফ-এ কাঁচের পাল্লা বসিয়ে সেলুনে বইয়ের আলমারি তৈরি করা হয়। তাতেই রাখা হয় বইগুলো।

পাঠাগারের কার্যক্রম বাজারের একটি ঘরে ওই আলমারির বই নিয়ে শুরু হয়। সেখানেই চলছিল পাঠাগারটি। একটি পৃথক ঘর পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থ ও সময়ের দুই ঝক্কি বাদ দিতে নিজের সেলুনেই আলমারি নিয়ে আসেন। মিলনের সেলুনটিই হয়ে ওঠে একের মধ্যে দুই -রোজগারের কেন্দ্র ও পাঠাগার। 

মিলনের পাঠাগারে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রসহ সেরা লেখকদের বিভিন্ন বই। এগুলোর অধিকাংশই কিনেছেন মিলন। আর কিছু বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেলুনে কেউ চুল কাটাতে এলে সময় কাটানোর জন্য তাকে দেয়া হয় বই। অপেক্ষার সময়টি বই পড়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়। চাইলে একটি খাতায় নাম, ঠিকানা লিখে বই বাড়িতেও নিতে পারেন পাঠক।

মিলন বলেন, উপজেলায় কোন পাবলিক লাইব্রেরি নেই। এ কারণে সেলুনে সব সময় বইপ্রেমীদের ভিড় থাকে। পুরনো লেখকদের বই পড়তে তার ভালো লাগে বিধায় তাদের বই সংগ্রহে বেশি। 

সেলুনে বই পড়তে আসা কামাল নামে একজন বলেন, বইয়ের টানে সেলুনে তিনি প্রায়ই আসেন। এক ধরনের ভিন্ন আড্ডার স্বাদে এই দোকানে সব বয়সী মানুষ ভিড় লেগেই থাকে।