• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে মিয়ানমারের বক্তব্য বনাম বাস্তবতা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২ জুন ২০১৯  

গত বছরের আগস্ট মাসে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযান ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। মানবতার কথা বিবেচনা করে নানা রকম সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশে। এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য সরকারিভাবে নানা রকম সুবিধাও দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। অন্যদিকে শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে দোষারোপ করে চলেছে মিয়ানমার।  

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধিবাসীদের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে মিয়ানমারে নিরাপদ ভাবে ফেরত পাঠানোর জন্য ২০১৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ শুরু করে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত একাধিক চুক্তি সম্পন্ন হলেও মিয়ানমারের নানা রকম টালবাহানার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের অনীহা, রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করা এবং আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনেকটাই মন্থর হয়ে পড়ে। এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যু ধামাচাপা দিতে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে অন্যায় ভাবে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের মালিকানা নিজেদের বলে দাবি করেছিলো। পরবর্তীতে বাংলাদেশের জোরালো প্রতিবাদের মুখে উক্ত দাবি থেকে সরে আসে মিয়ানমার। 

সম্প্রতি জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ শীর্ষক ২৫তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগের মতোই মিথ্যাচার করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন এখনো সম্পন্ন না হওয়ার জন্য বাংলাদেশের কাঁধে দোষ চাপিয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির অফিস বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কাইওয়া টিন্ট সয়ে অভিযোগ করে বলেন, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চল থেকে যেসব মানুষ পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী হয়েছে তাদেরকে ফেরত পাঠানো এবং আবাসিক কার্ড দেয়ার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করছে না বাংলাদেশ। এখানেই শেষ নয়। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেছেন, '২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার প্রতি কোনোই সম্মান দেখাচ্ছে না বাংলাদেশ। ওই চুক্তির অধীনে রোহিঙ্গা ও অন্য যেসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে'। তিনি বলেন, 'এই প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়া উচিত ছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে কোনো রোহিঙ্গা এখন পর্যন্ত ফেরত আসে নি'।

কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উক্ত চুক্তি সম্পাদনের পর শর্ত অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার। প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সহায়ক পরিবেশ তৈরি না করায় গত বছরের নভেম্বরে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। বাংলাদেশের নির্বাচনের পর সরকার ক্ষমতায় এসে এ নিয়ে যখন মনোযোগী হবে, এমন সময়টাতে রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এতে রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত প্রক্রিয়া শুরু করতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি মিয়ানমার।

প্রসঙ্গত গত বছরের ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বসতি স্থাপনবিষয়কমন্ত্রী উইন মিয়াত আইয়ে  তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। মিয়ানমারের মন্ত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। এসময় বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে  মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের পরিবারভিত্তিক তালিকা হস্তান্তর করেছে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমার ৫৫৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশকে দিয়েছিলো, যারা যেকোনো সময় মায়ানমারে ফিরতে পারবে বলে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তাদের বাছাই করা এই রোহিঙ্গাদেরও ফেরত নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকার কথা রয়েছে। রাখাইনে এসব ক্যাম্প তৈরিতে চীন ও ভারত সহায়তা দেয়ার কথা। তবে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ও বাড়ি পুনর্গঠন হয়ে গেলে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার কথাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে মিয়ানমার অঙ্গীকার করলেও এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত আন্তরিকতা দেখায়নি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে একদিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সকল মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে ফেরত নেওয়ার অঙ্গীকার করছে আবার অন্যদিকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় বলে অপপ্রচার করছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার সেদেশের ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই তালিকাভুক্ত করেনি। মিয়ানমার সরকারের মতে রোহিঙ্গারা হলো বাংলাদেশী যারা এতদিন ধরে অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছিলো। যদিও ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রোহিঙ্গারা কয়েক শতাব্দী ধরে স্থায়ীভাবে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। এমনকি ব্রিটিশরা মিয়ানমারে আসার কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে একটি নির্দিষ্ট জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিলো।