• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বস্তি দেবে দীর্ঘতম আন্ডারপাস

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২৩  

ঢাকা হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল, রেলওয়ে, বিআরটি, এমআরটি স্টেশন ও হজ ক্যাম্পকে সংযুক্ত করতে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আন্ডারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই দীর্ঘতম আন্ডারপাস নির্মিত হলে বিমানবন্দর এলাকার যানজট ও পরিবহন নৈরাজ্যের জন্য স্বস্তি মিলবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যাত্রী ও পথচারীরা এর মাধ্যমে নিরাপদে বাস, বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে পৌঁছাতে পারবেন। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রস্তাবিত আন্ডারপাসটিতে নয়টি প্রবেশ ও বহির্গমন পথ থাকবে। এগুলো হলো: হজ ক্যাম্প, আশকোনা, বিমানবন্দর রেলওয়ে (বিআরটি) স্টেশন, বিমানবন্দর টার্মিনাল-১, ২ এবং ৩, বিমানবন্দর উত্তর গেট, দক্ষিণ গেট এবং এমআরটি স্টেশন। এই আন্ডারপাস নির্মাণের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। সরকারি কোষাগার থেকে এই অর্থ খরচ করা হবে। প্রকল্পটির সময়কাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

দেশের অন্যতম ব্যস্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একদিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও অন্যদিকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মানুষকে লাগেজ হাতে রাস্তা পার হতে হয়। বাস বা ট্রেন ধরতে অন্যদিকে যেতে হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কাছাকাছি থাকা ফুটওভারব্রিজটি ব্যবহার করে ঘণ্টায় ১৪ হাজার ৭৭৭ জন চলাচল করতে পারলেও তা লোকসংখ্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। পাশে আশকোনা হজ ক্যাম্পে যাওয়া ব্যক্তিদেরও রাস্তা পারাপার হতে হয়।

জানা গেছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে প্রতিদিনই সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। দেশি-বিদেশি বিমান যাত্রীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে এবং বের হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে যে বিনিয়োগকারীরা আসছেন তাদেরও পড়তে হচ্ছে যানজট ভোগান্তিতে। বিমানবন্দরে এ ভোগান্তি যেন নিয়তি হয়ে গেছে। এই বিমানবন্দর এলাকায় আসলে কারোই যেন নিস্তার নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সব সময়ই লেগে থাকে যানবাহনের জটলা। বিশেষ করে পার্কিং করা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য গাড়ির কারণে এই জটলা সৃষ্টি হয়। এই যানবাহনের জটলা, অব্যবস্থাপনার পার্কিং ও দুর্ভোগ থেকে দ্রুত মুক্তি চান সাধারণ যাত্রীরা।

প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করা এই স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়তে হচ্ছে। বিমানবন্দর- গাজীপুর সড়কে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোর মানুষ এ পথেই যাতায়াত করেন। এমনকি ঢাকার মিরপুর, উত্তরা এলাকার মানুষ এ পথ ব্যবহার করে থাকেন। অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় শিক্ষার্থীরা চলাচল করেন। এসব নানা দিক বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো এই ধরনের আন্ডারপাস তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মতো যাত্রী সেবা ট্রাভেলেটর এই আন্ডারপাসে থাকবে বলে জানা গেছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। জেপিজেড কনসাল্টিং (বাংলাদেশ) লিমিটেড এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে বলেও নথিতে উল্লেখ আছে। আন্ডারপাসগুলোয় লিফট, এসকেলেটর, ট্রাভেলেটর (চলন্ত ওয়াকওয়ে) ও অন্যান্য সুবিধা থাকবে। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তাদের সামান্য তবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ তা পুনরায় জমা দিতে বলা হয়েছে।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আধুনিক এই আন্ডারপাস নির্মাণে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। সরকারি তহবিল থেকে এই অর্থের যোগান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরেই শুরু হবে প্রকল্পের নির্মাণকাজ। আগামী দু’বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে প্রস্তাবনায়। রেলওয়ে স্টেশন এবং এর চারপাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি বাস এবং মেট্রো স্টেশনসহ রাজধানীর ব্যস্ততম পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিমানবন্দর গোলচত্বর। এই এলাকায় একটি মাত্র ফুটওভার ব্রিজ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রী এ সড়কে চলাচল করে। গাজীপুর হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত বিমানবন্দর সড়কে প্রতিনিয়ত তীব্র যানজট দেখা যায়। ফুটওভারব্রিজ অপ্রতুল হওয়ায় বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও পথচারী এর নিচ দিয়েই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে বিধায় এ জায়গায় প্রায়ই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়; ঘটে দুর্ঘটনা। প্রস্তাবিত আন্ডারপাসটি তৈরি হলে যানজট ও দুর্ঘটনা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের (আরএইচডি) প্রস্তাব অনুযায়ী, আন্ডারপাসটি হবে শতভাগ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে থাকবে আটটি লিফট, ২৮টি এসকেলেটর এবং ২৫টি ট্রাভেলেটর। চলমান ওয়াকওয়ে হিসেবে পরিচিত ট্রাভেলেটর সাধারণত বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন বা শপিং মলের মতো জায়গায় মানুষের চলাচলে সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও নির্মাণ করছে। এর একটি বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এবং অন্যটি বিমানবন্দর থেকে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের ঢাকা ইপিজেড পর্যন্ত। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেল (ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট লাইন-১) বাস্তবায়নের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ডেডিকেটেড বাস করিডর নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করছে।

১ দশমিক ৭ কিলোমিটার টানেল নির্মাণে সর্বাধিক ৫৮৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং মাটি কাটা ও সেগুলো শক্তিশালী করতে ২২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। ৮টি লিফট, ২৮টি এসকেলেটর, ২৫টি ট্রাভেলেটর ও অন্যান্য সুবিধার জন্য খরচ হবে ১০৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বাকি টাকা অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হবে।

প্রস্তাবিত আন্ডারপাসটিতে নয়টি প্রবেশ ও বহির্গমন পথ থাকবে। হজ ক্যাম্প, আশকোনা, বিমানবন্দর রেলওয়ে (বিআরটি) স্টেশন, বিমানবন্দর টার্মিনাল-১, ২ এবং ৩, বিমানবন্দর উত্তর গেট, দক্ষিণ গেট এবং এমআরটি স্টেশন। প্রস্তাবিত আন্ডারপাস ব্যবহার করে হজ ক্যাম্প থেকে সরাসরি বিমানবন্দরের টার্মিনালে যাওয়া যাবে। আবার বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে সরাসরি এমআরটি (মেট্রোরেল) স্টেশনে যাওয়া যাবে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যা বাংলাদেশের ৩২ জেলাকে সংযুক্ত করেছে।

ব্যস্ততম এই মহাসড়কের একপাশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বিপরীত পাশে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন। বাস্তবায়নাধীন বিমানবন্দর টার্মিনাল ৩, এমআরটি লাইন-১, ঢাকা আশুলিয়া এক্সেপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি প্রকল্প বাড়িয়ে দিয়েছে এই অঞ্চলের কর্মব্যস্ততা। বর্তমানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় ১৪,৭৭৭ জন পথচারি ও যাত্রী একটি মাত্র ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে এই মহাসড়ক পারাপার হন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রস্তাবিত এলাকায় নতুন রেলওয়ে ট্র্যাক সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শীঘ্রই এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিআরটি বাস সুবিধা। এছাড়া এমআরটি-১ এর বাস্তবায়ন হলে এ এলাকায় যাত্রী চাপ বাড়বে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে প্রতিদিন প্রায় ৩,৬০,০০০ যাত্রী এ এলাকায় চলাচল করবে। এর একটা বড় অংশ আন্ডারপাসের সুবিধা নেবে।

বেসমারিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক মাস্টারপ্ল্যানে একটি মূল পথচারী টানেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিমানবন্দরের এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের আগে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিমানবন্দরটি ২০৩৫ সালের মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ যাত্রী পরিবহন করবে।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আন্ডারপাস নির্মাণের প্রস্তাব দেন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয় পথচারি আন্ডারপাস অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করতে একটি কমিঠি গঠন করে। কমিটি পুনরায় পরিদর্শন করে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে। ২০১৯ সালের মার্চে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বলেন, বিমানবন্দর এলাকাটি পরিবহন কেন্দ্রে পরিণত হবে। আন্ডারপাসটিতে এক মোড থেকে অন্য মোডে যাতায়াতের সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রস্তাবিত আন্ডারপাস ব্যবহার করে হজ ক্যাম্প থেকে সরাসরি বিমানবন্দরের টার্মিনালে যাওয়া যাবে। আবার বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে সরাসরি এমআরটি (মেট্রোরেল) স্টেশনে যাওয়া যাবে। যারা বিআরটি পরিবহন ব্যবহার করবে তারা আন্ডারপাসের মাধ্যমে রাস্তা পারাপার হতে পারবে। ভবিষ্যতে আন্ডারপাসটি একটি মাল্টিমোডাল হাব হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রথমবারের মতো এই ধরনের আন্ডারপাস তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মতো যাত্রী সেবা ট্রাভেলেটর থাকবে এই আন্ডারপাসে।