• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

১৯৪৭ সালে দীর্ঘ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে জন্ম নেয় দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। জাতিগত ও সংস্কৃতিগত মিল না থাকা স্বত্বেও শুধু মাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।এর পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার ছাত্র ও  বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন। রচিত হতে থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের পটভূমি।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকায় আয়োজিত এক সম্মেলনে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়, যা পাঠ করেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ওই প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন এবং আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক।’ পাকিস্তান সৃষ্টির পর এভাবেই সর্বপ্রথম মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে।

৪৭ এর ডিসেম্বরে কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৪ জন ভাষাপ্রেমিক বাংলা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন দাবি-সংবলিত ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন, যা পুস্তক আকারে প্রকাশ হয়ে নামকরণ হয়—‘রাষ্ট্রভাষা ২১ দফা ইশতেহার—ঐতিহাসিক দলিল’।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি স্মরণীয় দিন। গণপরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করার প্রতিবাদে ওইদিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগানসহ মিছিল করার সময় গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু।

পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দীদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেয়া হয়, অনুমোদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দী অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলাভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষা সৈনিকরা কারামুক্ত হন।

১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ১৯৪৯-এ শেখ মুজিব দুইবার কারারুদ্ধ হন। ১৯৫২ সালের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। কারা অভ্যন্তরে থেকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা পাঠাতেন।

এ বিষয়ে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’

প্রসঙ্গত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালীন বাঙালিদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার বিপক্ষে বিবৃতি দিলে আন্দোলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে তাঁর মত পরিবর্তন করিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে নতুন করে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করেন, যা শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল বলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিমত ব্যক্ত করেন। বায়ান্নর ২৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এ বিবৃতি প্রকাশিত হয়।

২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রতিনিধিত্ব সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩-এর একুশের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনে শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। উক্ত জনসভায় তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জোর দাবি জানান।

পরবর্তীতে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এসেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা।  

স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্ব মঞ্চে বাংলা ভাষায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু।

ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্থপতির ভূমিকা পালন করে পরবর্তীতে আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। এজন্যই বাঙ্গালী জাতি যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  শ্রদ্ধা ও বিনম্র চিত্তে স্মরণ করবে।