• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা মদ খেয়েছিল কেন?

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০২০  

‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ ভারতবর্ষের মৃত আত্মাকে স্মরণ করে আমি পান করছি’। টিপু সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক রিচার্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৯ সালের ৪ মে, দিনটি এভাবেই উদযাপন করেছিলেন। 

ভগবান এস গিদুয়ানের ‘দ্য সোল্ড অব টিপু সুলতান’ বইটিতে এমনভাবেই উল্লেখ্য রয়েছে। টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনে ওয়েলেসলি যে দুটি মন্তব্য করেছিলেন তাতে স্পষ্টত যে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের বড় বাঁধাগুলোর একটি ছিলেন টিপু সুলতান। ভারতের বেশির ভাগ অংশে আজো তাকে সেভাবেই দেখা হয়। 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ব্রিটিশদের কাছে টিপুর নাম ছিল এক বিভীষিকা। টিপু সুলতানের বীরত্ব, সাহসিকতা ও জ্ঞানই তাকে এক অনন্য স্থানে পৌঁছে দেয়। ইতিহাসবিদরা তাকে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। নবাব হায়দার আলী খানের অসমাপ্ত কাজগুলো তার সন্তান হিসেবে সম্পন্ন করাই ছিল তার নেশা। মহীশুরের সর্বশেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন টিপু সুলতান। তার ছিল অদ্ভুত এক নেশা। বাঘকে খুব পছন্দ করতেন তিনি। কখনো ভাবা যায়! বাবার হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু সুলতান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নেন। প্রথশ থেকেই তার বিশেষত্ব ও গুণাবলী সবার নজর কাড়ে। খোদ ব্রিটিশ সরকারও মহীশূরের বাঘকে তোষামদ করে চলতেন।    

সতের শতক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। তখন থেকেই তারা ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং তা রক্ষা করার জন্য ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া শুরু করে। তবে তারা প্রথম থেকেই সেখানে বেতন, মান-মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার ছিল। অন্যদিকে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানি ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক দখল হয়ে যাচ্ছিল। যারা টিকে ছিল তারা ব্রিটিশ দাসত্ব কবুল করে নিতে বাধ্য হয়। সেসময় দক্ষিণ ভারতের মহীশুরের রাজাধিরাজ টিপু সুলতান মহাপরাক্রমে সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন।

চারদিকে তার নাম-ডাক। সামরিক ও বেসামরিক উভয় শিক্ষায় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন টিপু সুলতান। তিনি জানতেন আধুনিক রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? ব্রিটিশদের হাতেই যে তার পরাজয় ছিল সে আর কে জানত? চতুর্থ ইঙ্গ-মহিশূর যুদ্ধে ১৭৯৯ সালের ৪ মে মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতান মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতা হায়দার আলীই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন প্রথম। তবে ইতিহাসবিদরা বলেন, শ্রীরঙ্গপত্তম পরাজয় ঘটে টিপুর অযোগ্যতার জন্য নয়, কৌশলে ব্যর্থতার কারণে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো-

সেনাবাহিনী 

হায়দার আলী রণাঙ্গণে প্রধানত ব্যবহার করেন অশ্বারোহী বাহিনী। ১৭৮০ সালে হায়দারের অশ্বারোহীদের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার আর পদাতিক ছিল ২৭ হাজার। অন্যদিকে, টিপু সেনা সংগঠনে পরিবর্তন এসে অশ্বারোহীর সংখ্যা হ্রাস করে পদাতিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন। ১৭৯১ সালে বাঙ্গালোর বা বেঙ্গালুরুর যুদ্ধের প্রাক্কালে টিপুর অশ্বারোহীর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার আর পদাতিকের সংখ্যা ৭০ হাজার। তার আমলে সেনাদের বেতন দেয়া হত অনিয়মিতভাবে। বেতন দিতে গিয়ে তিনি ৩০ দিনে মাস না ধরে ৩৫ দিনে মাস ধরার জন্য পরোয়ানা জারি করেন। ৩৫ দিনে মাস ধরেও আবার বেতন বাকি রাখা সে সময়ে এক রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। 

ফলে উচ্চাভিলাষী বকশীদের পক্ষে ষড়যন্ত্র করার ক্ষেত্র সুগম হয়েছিল। গোলন্দাজ বাহিনীতে ছিল বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভাড়াটে সৈন্য যারা যুদ্ধ জয়ের চেয়ে আপন জীবন রক্ষা করায় ছিল বেশি তৎপর। মহীশূরের হিন্দু রাজার সেনাবাহিনীতে গড়ে ওঠা হায়দারের মধ্যে ধর্মীয় গোড়ামি ছিল না। তার-সেনা এবং সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু। তবে টিপু ছিলেন গোড়া মুসলমান। সমকালীন অন্যান্য মুসলমান শাসকদের মতো তিনিও সেনাবাহিনী তৈরি করেন। মুসলমান দিয়ে আর হিন্দুদের প্রাধান্য দেন প্রশাসনে। সেনাবাহিনী সংগঠনে টিপুর সংস্কার নীতি মোটেই ফলপ্রসু হয়নি। এতে সেনাবাহিনীতে হতাশা বড়ে। বাঙ্গালোর যুদ্ধের পরাজয়ের পর সাদিক খানের মতো অনেক সিপাহীরাই উচ্চাভিলাষবশত টিপুর ধ্বংস কামনা করে।

কুসংস্কারের শিকার

হায়দার প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। টিপু ছিলেন বিদ্বান, বহু ভাষায় দক্ষ এবং সমকালীন বিশ্বরাজনীতি ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতন। তবে তথাপি হায়দার নন, টিপুই ছিলেন নানা কুসংস্কারের শিকার। তিনি বিশ্বাস করতেন তার সরকার আল্লাহ প্রদত্ত (খোদাদাদ-সরকার)। তিনি ভুল করতে পারেন না। কারণ তার সিদ্ধান্তে রয়েছে আল্লাহর আশীর্বাদ। তার এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যই তিনি তার সেনাবাহিনী থেকে হিন্দুদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে ইংরেজরা দেওয়ানী লাভের পর বিচার ব্যবস্থা থেকে ইসলামি আইন বাদ দেয়। শাহ আব্দুল আজিজ ভারতকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। 

তার এই ফতোয়ায় তার প্রধান শিষ্য সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও হায়দারাবাদের সুলতান টিপুর মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সুলতান টিপু দেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এছাড়াও টিপুর প্রাত্যহিক জীবন পরিচালিত হতো প্রধানত জ্যোতিষীদের উপদেশ অনুসারে। নিজাম, মারাঠা, ইংরেজরা কোন সময় তার কি ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং কিভাবে তাদের মোকাবিলা করা যেতে পারে সে সম্পর্কে তিনি জ্যোতিষীদের পরামর্শ চাইতেন। তিনি স্বপ্নেও বিশ্বাস করতেন এবং প্রতিটি প্রশ্ন তিনি ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করে স্বপ্নশাস্ত্রীদের সহায়তার বিশ্লেষণ করতেন।

বিজয়ের নেশা 

১৭৮৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলার ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্ণর জেনারেল চার্লস লর্ড কর্ণওয়ালিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতি বাস্তবায়ন করতে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় তার সাম্রাজ্য জয়ের নতুন যাত্রা। এরই মধ্যে কর্ণওয়ালিসের সাম্রাজ্য বিজয়ের নেশায় আক্রান্ত হলেন টিপু সুলতান। তিনি মনে করতেন, ইংরেজরা এসেছে বাণিজ্য করতে। তারা কেন অন্য বিষয়ে নাক গলাবে? টিপু সুলতানের এমন মনোভাব মানতে পারছিল না ইংরেজরা। 

কাজেই শের বধ করতেই হবে। সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এক সময় ঝাঁপিয়ে পড়লেন কর্ণওয়ালিস। তবে শের-ই-মহীশুরকে বধ করা তো আর সামান্য কথা নয়। কর্ণওয়ালিসের বাহিনীকে ফিরে যেতে হলো প্রথম যাত্রায়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা মরিয়া কর্ণওয়ালিস ১৭৯০ সালে দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করলেন নিজে। এ যাত্রায় সফল হলেন তিনি। যুদ্ধে নির্মমভাবে নিহত হলেন পরাক্রমশালী শাসক টিপু সুলতান। 

অস্তমিত হলো মহীশুর সাম্রাজ্যের সূর্য, যা উদ্ধার করতে উত্তর প্রজন্মকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সাম্রাজ্য জয়ের নেশায় কর্ণওয়ালিসের লোপ পায় ভেতরের ন্যায়-অন্যায় বোধ। সমর পরিকল্পনার কোনো রকমের ছাড় দিলেন না কর্নওয়ালিস। তার সমর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঘটালেন ইতিহাসের জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। যুদ্ধে টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর কর্নওয়ালিস টিপুর ছোট ছোট দুই শিশুকে বন্দি করে নিয়ে যান। 

সবাইকে হুশিয়ার করে গেলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ হলে টিপু সুলতানের দুই শিশুপুত্রকে মেরে ফেলা হবে। অবশ্য টিপু সুলতানের দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে অন্যায় করলেও তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন কর্নওয়ালিশ। ফলে তারাই ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম উচ্চ শিক্ষিত পরিবার। টিপু সুলতানের বংশধররা এখনো ভোগ করছেন সেই সুবিধা। তবে বর্তমানে টিপুর বংশধররা কেউ চালাচ্ছেন রিক্সা, কেউবা অন্যের ঘরে কাজ করছেন। এভাবেই পেট চালাচ্ছেন তারা।