• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় তাকে, ৫০ বছরেও সমাধান হয়নি মৃত্যু রহস্য

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ মে ২০২০  

অজ্ঞাত এক নারীর পোড়া দেহের সন্ধান মেলে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে। নরওয়ের ইসডালেন উপত্যকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পুরোপুরি পুড়ে যাওয়া ওই নারীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। 

মৃত নারীর পোশাকসহ কাছে থাকা জিনিসপত্রগুলো এমনভাবে ধ্বংস করেছিল যাতে তার পরিচয় শনাক্ত করা না যায়। পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও ৫০ বছর পর এখনো এই মৃত্যুর রহস্য সমাধান হয়নি। 

পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় মৃতদেহটি যে স্থানে মিলেছিল সেখানকার নামানুসারে ইসডাল ওম্যান হিসেবেই অভিহিত করা হয় মৃত নারীকে। তদন্তের সময় বেশ কিছু ধাঁধায় ফেলে দেয়ার মত সূত্র পায় পুলিশরা। ইসডাল ওম্যানের মৃত দেহ পাওয়া গিয়েছিল ‘ডেথ ভ্যালিতে’। এটা ঘটনাটির প্রথম সূত্র ছিল। 

১৯৭০ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে নরওয়ের ইসডালেন উপত্যকায় এক ব্যক্তি এবং তার দুই মেয়ে একটি লাশ দেখতে পায়। সেটা একজন নারীর দেহ ছিল। কয়েকটি পাথরের উপর খুব বাজেভাবে পুড়ে যাওয়া দেহটি পড়েছিল। ইসডালেন স্থানীয়দের কাছে ওই স্থানটি ‘ডেথ ভ্যালি’ বা মৃত্যু উপত্যকা নামে পরিচিত। মধ্যযুগে এখানে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করত। 

 

ইসডাল ওম্যানের লাশ এখানেই পড়ে ছিল

ইসডাল ওম্যানের লাশ এখানেই পড়ে ছিল

১৯৬০ এর দশকে কুয়াশার মধ্যে ট্র্যাকিংয়ের সময় কিছু পর্বতারোহণকারী মৃত্যুবরণ করেছিল। তবে মৃতদেহ পাওয়া নারী পর্বতারোহণকারী ছিলেন না। এই ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মৃতদেহটি একটি দুর্গম অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল। মৃত নারীর পুরো শরীর পুড়ে গিয়েছিল। ফলে তার পরিচয় জানার কোনো উপায় ছিল না। 

মৃতদেহটি কতক্ষণ সেখানে পড়েছিল কিংবা কীভাবে পুড়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। এর দ্বিতীয় সূত্র ছিল, ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত জিনিসপত্র। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গয়না, একটি ঘড়ি, একটি ভাঙা ছাতা এবং কয়েকটি বোতলসহ অন্য কিছু বস্তুর সন্ধান পেয়েছিল। অবাক করা বিষয় হলো, মৃত নারীর গয়না তার শরীরে নয় বরং পাশে পড়ে ছিল। ফরেনসিক তদন্ত কর্মকর্তা টর্মোড বেনস বলেন, জিনিসগুলো তার চারপাশে এমন অদ্ভুতভাবে ছড়িয়ে ছিল দেখে মনে হয়েছিল সেখানে কোনো অনুষ্ঠান চলছিল। 

পুলিশ সেখানে এক জোড়া রাবার বুট এবং নাইলন স্টকিংয়ের অংশও খুঁজে পেয়েছিল। ফরেনসিক তদন্ত কর্মকর্তা টর্মোড বলেন, মৃত নারী সিনথেটিক উপকরণের প্রচুর পোশাক পরেছিলেন। যেগুলোর বেশিরভাগই পুড়ে গিয়েছিল। রহস্যের বিষয় হলো, তার পোশাকের লেবেলগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল এবং বোতলগুলোতেও কোনো চিহ্ন ছিলনা। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মৃত নারীর পরিচয় শনাক্ত করার মতো কিছুই খুঁজে পায়নি। 

পুলিশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য গ্রহণ করে। তারা জানায়, ওই নারীর উচ্চতা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। মুখ ছিল গোলাকার এবং লম্বা বাদামি-কালো চুল ছিল। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল অনুমানিক ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। নাম পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় মৃত নারীর নাম ইসডাল ওম্যান বলেই পরিচিত পায়। 

 

লাশের পাশ থেকে পাওয়া গয়না ও ঘড়ি

লাশের পাশ থেকে পাওয়া গয়না ও ঘড়ি

তদন্ত শুরুর কয়েক দিন পর পুলিশ একটি সূত্র পায়। বার্জেন রেলওয়ে স্টেশনের লাগেজ ডিপার্টমেন্ট বিভাগ থেকে দুটি স্যুটকেস পাওয়া যায়। স্যুটকেসগুলোর একটিতে প্রেসক্রিপশনবিহীন চশমা ছিল। এই চশমায় থাকা আঙুলের ছাপ আকস্মিকভাবে মৃত ওই নারীর সঙ্গে মিলে যায়। স্যুটকেসগুলোতে অন্যান্য বেশ কিছু জিনিসও পাওয়া গিয়েছিল। 

এর মধ্যে পোশাক, বেশ কয়েকটি পরচুলা, জার্মান ও নরওয়ের অর্থ, ব্রিটিশ এবং বেলজিয়ামের কয়েন ছিল। এছাড়া একটি প্রেসক্রিপশনসহ একজিমা ক্রিম, চিরুনি ও কিছু কসমেটিকও ছিল। পুলিশ এসব জিনিসের সন্ধান পেয়ে প্রাথমিকভাবে মৃত নারীর পরিচয় শনাক্তকরণে সহায়তা করবে ধারণা করেছিল। তবে পুলিশ খুব শীঘ্রই বুঝতে পারে এই প্রমাণ থেকে তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তার পোশাক এবং জিনিসপত্রে শনাক্তযোগ্য সব লেবেল সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। 

এমনকি একজিমা ক্রিমের প্রেসক্রিপশন স্টিকার, চিকিৎসক এবং রোগীর নাম কাঁটা ছিল। পুলিশ প্যারিসসহ ইউরোপের অনেক শহরের বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সেসব শনাক্ত করতে পারেনি। নরওয়ের স্টানভাঞ্জারের একটি জুতার দোকান থেকে ব্যাগ এবং রাবার বুট কিনেছিল বলে পুলিশ প্রমাণ পায়।

এই দোকানের মালিকের পুত্র বর্ণনা করেছিলেন, খুব সুন্দর পোশাক পরিহিত কালো চুলের এক নারী তার কাছ থেকে এক জোড়া রাবার বুট কিনেছিলেন। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন এবং শান্ত স্বভাবের ছিলেন।পুলিশের ধারণা, মৃতদেহের কাছ থেকে পাওয়া বুটের সঙ্গে এটা মেলে। পুলিশ জুতার দোকানের মালিকের পুত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, পাশের সেন্ট সোভিতুন হোটেলে মেয়েটির থাকার তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

ইসডাল ওম্যান দেখতে কি এমনই ছিলেন?

ইসডাল ওম্যান দেখতে কি এমনই ছিলেন?

হোটেলে তিনি ফেনেলা লোরচ নামে চেক ইন করেছিলেন। পুলিশ পরে বুঝতে পারেন ফেনেলা লোরচ তার আসল নাম নয়। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে মেয়েটি ১৯৭০ সালের ২১ মার্চ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৯টি হোটেলে ছিলেন। প্রতিটি হোটেলে চেক ইনের সময় ভিন্ন ভিন্ন নাম এবং পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন। তার কাছে বেশ কয়েকটি জাল পাসপোর্ট ছিল বলে জানা যায়। 

পুলিশ ইসডাল ওম্যান সম্পর্কে কয়েকটি হোটেলের স্টাফদের কাছ থেকে শুনেছিলেন। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, এই নারী সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতেন এবং কিছু জার্মান ফ্রেজও ব্যবহার করতেন। তিনি পরিমার্জিত সুন্দরী নারী ছিলেন। হোটেল স্টাফদের বর্ণনা অনুযায়ী, একই হোটেলে থাকার সময় কয়েকবার রুম পরিবর্তন করতেন। সে সময় এই নারী সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি একজন গুপ্তচর। 

তাদের যুক্তি অনুযায়ী, এই নারীর বেশ ধনী ছিল। আর নরওয়ের বার্জেনে তখন বিদেশি পর্যটক খুব কমই আসত। বার্জেনভিত্তিক অপরাধ লেখক স্ট্যালেনসেন মত প্রকাশ করেছিলেন, এটি স্নায়ু যুদ্ধ চলার সময় ছিল এবং সেসময় নরওয়েতে রাশিয়ান গুপ্তচরসহ অন্যান্য দেশের গুপ্তচররাও সক্রিয় ছিল। তিনি আরো বলেন, ইসরায়েলের গুপ্তচর এজেন্টরাও সেখানে সক্রিয় ছিল। নরওয়ের গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে তদন্ত করলেও কয়েক দশকেও কোনো কিছুই স্বীকার করেনি। 

 

মৃত্যুর ৫০ বছর পরও তার পরিচয় জানা যায়নি

মৃত্যুর ৫০ বছর পরও তার পরিচয় জানা যায়নি

পুলিশ ইসডাল ওম্যানের কাছ থেকে একটি কোডেড নোট পেয়েছিল। তবে এটি পরীক্ষা করে গুপ্তচর হওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি। নোট থেকে তার ভ্রমণ করার স্থানগুলোর নাম এবং তারিখ পাওয়া যায়। ময়না তদন্ত থেকে জানা যায় তার কাধের ডান দিকে আঘাতের চিহ্ন ছিল। হয়তো পড়ে যাওয়ার কারণে হতে পারে। তার অসুস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ ছিল না। ময়না তদন্ত থেকে আরো জানা যায় সে কখনো গর্ভবতী হয়নি। 

ফরেনসিক তদন্ত কর্মকর্তা টর্মোড বলেন, তার ফুসফুসে ধোঁয়ার কণা ছিল যা থেকে বোঝা যায় জ্বলন্ত অবস্থাতেও তিনি বেঁচে ছিলেন। তাকে পোড়াতে পেট্রোল ব্যবহার করা হয়েছিল। রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের ঘনত্ব ছিল প্রচুর। বিশেষজ্ঞরা তার পেটে ফেনামাল নামক প্রায় ৭০টি ঘুমের ওষুধ পেয়েছিল। তবে পোড়ার আগে তার মৃত্যু হয়নি। ময়নাতদন্তের পর পুলিশ আত্মহত্যা বলে মত প্রকাশ করলেও অনেকেই সেটা বিশ্বাস যোগ্য নয় বলে মনে করেন। এখনো পর্যন্ত ইসডাল ওম্যানের মৃত্যু রহস্য সমাধান হয়নি।