• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সাপের বিষ শরীরে নিয়ে ডায়েরি লিখেছেন যিনি

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৮  

১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। শিকাগো শহরের লিঙ্কন পার্ক চিড়িয়াখানার পরিচালক শহরের ফিল্ড মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে একটি সাপ পাঠিয়েছিলেন গবেষণার জন্য।

৭৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের সরীসৃপটি পরীক্ষা করার কথা কার্ল প্যাটারসন স্মিথ নামে একজন সাপ গবেষকের। ওই মিউজিয়ামে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর কাজ করেছেন।

‘কোরাল স্নেক’ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যাটারসন স্মিথ ১৯৫৫ সালে মিউজিয়ামের মুখ্য তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অবসরে যান এবং ততদিনে তিনি সরীসৃপ বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালাগুলোর একটি গড়ে তোলেন।

সাপটির মাথা উজ্জ্বল রঙের নকশায় ঢাকা ছিল এবং এর মাথার আকৃতি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গেছো সাপের মতো, যেগুলো বুমস্ল্যাং নামেও পরিচিত, এমনটাই লিখেছেন স্মিথ ।

এরপর তিনি যেটি করলেন তার জন্য জীবনের ব্যাপক মূল্য দিতে হয়। তিনি সাপটিকে আরও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করবার জন্য নিজের কাছাকাছি তুলে ধরলেন। সাথে সাথে সাপটি তার বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলে কামড়ে দেয়, ফলে সেখানে দুটো ছোট রক্ত-চিহ্ন দেখা যায়।

কিন্তু কোনো ধরনের চিকিৎসা সহায়তা না নিয়ে নিজের আঙ্গুল থেকে রক্ত চুষে নিতে শুরু করলেন স্মিথ। এরপর নিজের ওপর বিষের প্রভাব কি হচ্ছে তা লেখার জন্য তিনি নোটখাতার দিকে ফিরে গেলেন। এর ২৪ ঘণ্টারও কম সময় পর তিনি মারা যান।

স্মিথ এর শেষ দিনটি

স্মিথ মনে করতেন, এই ধরনের বুমস্ল্যাং মানব মৃত্যুর কারণ হওয়ার মত যথেষ্ট বিষ উৎপাদন করতে পারেনা। ফলে তার মৃত্যুর আগের কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি বাড়িতে ছুটে যান এবং তার শরীরের বিষের কি প্রভাব হচ্ছে সেটি রেকর্ড করেন।

মার্কিন রেডিও পিআরআই-এর সায়েন্স ফ্রাইডে নামে একটি অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও প্রকাশ করে যার শিরোনাম ‘ডায়েরি অফ এ স্নেকবাইট ডেথ’ অর্থাৎ সাপের দংশনে মৃত্যুর ডায়েরি। যেখানে ডক্টর কার্ল পি স্মিথ -এর জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টার বিস্তারিত বিবরণ তুলেরা হয়েছে তার নিজেরই বর্ণনায়।

‘বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা: প্রচন্ড গা গুলাচ্ছে কিন্তু বমি হয়নি। শহরতলীর একটি ট্রেনে চেপে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।’

বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা: প্রচন্ড ঠাণ্ডা এবং কাঁপুনি দিয়ে ১০১.৭ ডিগ্রি জ্বর। মুখ দিয়ে কফের সাথে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে

বিকেল ৫:৩০টা: রক্ত বেরোচ্ছে, বেশিরভাগই মাড়ি থেকে।

রাত সাড়ে ৮টা: দুই টুকরো মিল্ক টোস্ট খেলাম।

রাত ৯টা থেকে ১২:২০ মিনিট: ভালই ঘুমালাম।

রাত ১২:২০ মিনিট: প্রস্রাব করলাম। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেল, তবে পরিমাণ অল্প। ৪:৩০ মিনিট: এক গ্লাস পানি পান করলাম। প্রচণ্ড গা গুলানো এবং বমি বমি ভাব। হজম না হওয়া খাবার পাকস্থলী থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর কিছুটা ভালো লাগছিল এবং ভোর সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ঘুমালাম।

স্মিথকে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে চিকিৎসা সহায়তা করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যে সমস্ত উপসর্গ তিনি অনুভব করছিলেন সেগুলো যদি না বুঝতে না পারেন, সে আশঙ্কায় চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হননি তিনি।

এর বদলে নিজের বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সকালের নাশতার পর চমৎকার নোট লিখেছিলেন।

২৬শে সেপ্টেম্বর, ভোর ৬:৩০ মিনিট: তাপমাত্রা ৯৮.২. সিরিয়াল এবং টোস্টের সাথে ডিম পোচ, আপেল সস এবং কফি দিয়ে সকালের নাশতা খেলাম। প্রতি তিন ঘন্টায় প্রস্রাব নয়, এক আউন্স করে রক্ত বের হচ্ছে। মুখ এবং নাক দিয়ে রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, তবে খুব বেশি নয়।

শিকাগো ডেইলি ট্রিবিউনে ১৯৫৭ সালের ৩ অক্টোবর এভাবেই শিরোনাম হয় স্মিথের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা

আর এটিই ছিল স্মিথের লেখা সর্বশেষ কথা। বলছে সায়েন্স ফ্রাইডে।

দুপুর দেড়াটার দিকে মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি বমি করেন এবং স্ত্রীকে ডাকেন। যখন তাকে সহায়তা দেয়া শুরু হল ততক্ষণে তিনি অচেতন হয়ে হয়ে গেছেন এবং তার শরীরের প্রচণ্ড ঘামে ভিজে গেছে।

ডাক্তার ডাকার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। বিকেল তিনটার মধ্যে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর কারণ দেখানো হয় ‘রেসপিরেশন প্যারালাইসিস’। ফুসফুসে রক্তক্ষরণের কারণে তার শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল। চোখ, ফুসফুস কিডনি হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিস্কে অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়।

স্মিথ-এর মৃত্যুর পর দুই দশক ধরে চলা নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে বুমস্ল্যাং গোছের সাপ আফ্রিকান অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সাপের অন্যতম যার অত্যন্ত টক্সিক বিষ রয়েছে। এর কামড়ে রক্ত জমাট হওয়ার ক্ষমতা থাকেনা। ফলে রক্তপাতের শিকার হয়ে মানুষ মারা যায়। এই গেছো সাপ মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা এলাকায় দেখা যায় এবং পূর্ণবয়স্ক একেকটি সাপ ১০০থেকে ১৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কোন কোনটি ১৮৩ সেন্টিমিটারও হয়।

স্মিথ এবং তার সহকর্মীরা কেউই এই সাপটির দংশনকে খুব একটা গুরুতর বলে আমলে নেননি। কারণ বুমস্ল্যাংটি ছোট ছিল এবং দংশিত ব্যক্তি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।কিন্তু অন্যরা লিখেছেন, স্মিথ-এর জানবার কথা যে সেসময় বুমস্ল্যাং এর এন্টিভেনম ওষুধ সহজলভ্য ছিলনা ।

স্মিথ-এর জীবনের জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ শেষ মুহূর্তগুলোতে তার মনের ভেতর যা-ই চলুক না কেন, নিজের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে পৌঁছেও পিছু হটেননি। সায়েন্স ফ্রাইডে অনুষ্ঠানের প্রযোজক টম ম্যাকনামারা সেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। বরং তিনি ‘অজানা জগতে ঝাঁপ দিয়েছেন’।