• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বজন হারানোর পরে শোক পালনেরও সুযোগ দিচ্ছে না করোনা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১২ মে ২০২১  

বিধবা মা। মেয়ে অসুস্থ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ২৮ বছরের ছেলে। সেই ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে করোনা। বাড়িতে নাতনি, বউমা, অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কী ভাবে পরের পদক্ষেপ স্থির করবেন মা? মনোবিদের কাছে সেটাই প্রশ্ন তার।

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বিয়ে করেছিলেন বছর ৩৫-এর ব্যাঙ্ককর্মী। তার পরেই শুরু হল করোনার দাপট। কাজের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হত, তাই অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী থাকছিলেন মা-বাবার কাছে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরলেন স্বামীর মৃত্যু সংবাদে। এক সপ্তাহ করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের শেষ হল যে দিন।

বাবা-মা-ছেলে করোনায় আক্রান্ত। মা ক্যানসারের রোগী। তাই তাকেই বেশি আগলাতে হয়েছে। এরইমধ্যে বাবার অবস্থার অবনতি ঘটে। হাসপাতালে কয়েক দিন কাটিয়ে মৃত্যু। বাবার শেষযাত্রায় সঙ্গে থাকেননি কেউ। করোনায় বের হওয়া যাবে না, তাই। ছেলের একটাই চিন্তা, বাবার দেহ ঠিক ভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তো?

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এমনই ভাবে মৃত্যু ডেকে আনছে যে, শোক পালনের সুযোগও পাচ্ছে না অধিকাংশ পরিবার। তার মধ্যেই চলছে বাকিদের সুস্থ থাকার চেষ্টা। বেঁচে থাকার জন্য সতর্কতা। যে চলে গিয়েছে, তাকে নিয়ে আর ভাবার সময় নেই যেন। আসলে সময় থাকলেও সাহস নেই আপাতত। বাকিদের জন্য আতঙ্কের মাঝে অব্যক্তই থাকছে শোকের অনুভূতি। এমন পরিস্থিতি কি পরবর্তীকালে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব ফেলতে পারে? কী বলছেন মনোবিদেরা?

এখন দুঃখ প্রকাশ, বা নিয়ম মেনে শোকসভার অবকাশ নেই। কিন্তু যে কোনও মৃত্যুর পরে এটুকু প্রয়োজন হয় আগামী দিনে এগিয়ে চলার জন্য। তা না হলে পরবর্তীকালে এর একটা ভয়াবহ প্রভাব মানুষর মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে পড়তে পারে বলে মনে করেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তার বক্তব্য, এখন পরিস্থিতির ভয়াবহতায় অধিকাংশেই হতবাক। স্বজনের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ নেই। তবে একটা সময় এই অবস্থা থেকে সকলেই বেরোবেন। তখন আরও বেশি করে এই শোক ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, ‘‘শোক পালনের যে সব নিয়ম, তা সাহায্য করে মৃত্যুকে মেনে নিতে। এ ক্ষেত্রে সে সব হওয়া সম্ভব নয়। একের পর এক ধাক্কা আসছে। এমন ক্ষেত্রে শরীরের উপরের প্রভাব পড়ে।’’

নিজেকে সময় দিতে বলা হয় সাধারণত যে কোনও মৃত্যুর পরে। এ ক্ষেত্রে সেই সময়টা পাওয়া যাচ্ছে না বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার জন্য। ফলে এখন অধিকাংশেই সেই আবেগের সঙ্গে বোঝাপড়া করার সময় পাচ্ছেন না বলে বক্তব্য মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

তার বক্তব্য, এখন একের পর এক ঘটছে। অনেকেই যেন অসাড় হয়ে গিয়েছেন এই সব খবরে। যখন পরপর দুর্যোগ আসতে থাকে, তখন অনেক সময়ে আবেগের তীব্রতায় অসাড়তা আনাও প্রয়োজন হয়। তা না হলে তার সঙ্গে টিকতে পারা মুশকিল হয়। বহু বছর পরে অনেক সময়ে এই না যাপন করা কষ্ট ফিরে আসতে পারে।

কী ভাবে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা যায় এই পরিস্থিতির মধ্যে?

কান্না পাওয়া স্বাভাবিক। স্বজন বিয়োগ ঘটলে দুঃখ হওয়ায় তো দোষ নেই। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন। যেমন ভাবে তাঁর জীবনাবসানের বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে, তা করাই ভাল বলে বক্তব্য অনুত্তমার। চোখে জল এলে, তা বেরোতে দেওয়া জরুরি। যে কোনও কিছুর একটা শেষ টানা দরকার। করোনা তা করতে দিচ্ছে না। তবে নিজের মতো করে একটা সমাপ্তি টানতে পারলে ভাল। না হলে তার প্রভাব পড়বে বাকি সব সিদ্ধান্ত, কাজে। শোককে ধামাচাপা দিয়ে চলা সম্ভব হয় না।

অনুত্তমার আরও বক্তব্য, প্রিয়জনের মৃত্যুতে যেন অপরাধবোধ না ঘিরে ধরে। সংক্রমণ এক জনের থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়াচ্ছে। বিশেষ কে বাড়ির মধ্যে। সংক্রমিতদের অনেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন, কেউ কেউ পারছেন না। কিন্তু কার থেকে তা ছড়াল, তা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে নেই। যত্নে কোথাও ত্রুটি রয়ে গেল কি না, এ ধরনের কথা ভেবে, নিজেকে দোষ দিলে চলবে না।

সময়ের সঙ্গে নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নিতে হবে। মৃত্যুর সময়ে বহু ক্ষেত্রেই পাশে থাকা যাচ্ছে না। তবে যে সময়টা একসঙ্গে কাটানো হয়েছে, সেই স্মৃতিগুলো ধরে রাখা জরুরি। সময়ের যে দাবি, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। শেষ দেখা হল না কেন, শেষযাত্রায় পাশে থাকা হল না, ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়া হল না— প্রিয়জনের হঠাৎ মৃত্যুর পরে এমন সব আক্ষেপ ধরে রাখলে নিজের কষ্ট বাড়বে।

সূত্র: আনন্দবাজার