• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

সিংগাইরে নিজ গ্রামেই অবহেলিত ভাষা শহীদ রফিক

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন, মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষি হয়েছেন। নির্মিত হয়েছে তার নামে স্মৃতি জাদুঘর। কিন্তু ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহম্মদের নামে নির্মিত স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পরেও সেখানে নেই রফিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। তার নামে লেখা একটি মাত্র বই গ্রন্থাগারের আলমিরায় থাকলেও বাকি শহীদদের নিয়ে লেখা কোনো বই সেখানে নেই। শুধু তাই নয়, জাদুঘরে থাকা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত বিরল ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ ভাষার মাস এলেই ধোয়ামোছা আর দায়সারা দায়িত্ব পালন করেই দায়িত্ব শেষ করেন কর্তৃপক্ষ। এমন দুরবস্থা দেখে হতাশ হয়েই ফিরতে হয় দর্শনার্থীদের।

জানা যায়, ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল গ্রামে (বতর্মানে রফিকনগর) আবদুল লতিফ মিয়া এবং রাফিজা খাতুন দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন রফিক উদ্দিন আহম্মদ। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে বড়।
১৯৪৯ সালে রফিক উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। এরপর ভাষা আন্দোলনের সময় রফিক ঢাকার জগন্নাথ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বিয়ে ঠিক হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি বিয়ের শাড়ি-গহনা নিয়ে সন্ধ্যায় তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে মিছিল বের হবে শুনে তিনি ছুটে যান সেই মিছিলে।
এদিকে আন্দোলন ঠেকাতে তৎকালীন সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে তিনিও ছাত্র-জনতার সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল এলাকায় মিছিলে অংশ নেন। পাকিস্তান সরকার সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন রফিক। পরে ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ১৯৫২ সালে যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা বাংলা অর্জন করেছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
এরপর রফিকের স্মৃতিবিজড়িত পারিল গ্রামে শহীদ হওয়ার দীর্ঘ ৫৬ বছর পর ২০০৮ সালের ২৪ মে জেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয় ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।

সিংগাইর উপজেলার বর্তমানে রফিক নগরে ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহম্মদের নামে নির্মিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার কাজ। জাদুঘরের সামনে চলছে ৪দিন ব্যাপি মেলা।
জাদুঘরে আগত নানা বয়সী এবং পেশার দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের হতাশার কথা। তারা জানান, শুনেছি শহীদ রফিকের ব্যবহৃত চশমা, নকশিকাঁথা, কলম, রুমালসহ বেশ কিছু জিনিস রয়েছে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন কিংবা সে সময়ের স্মৃতি বিজড়িত কোনো কিছুই নেই। জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে যে আলোকচিত্রগুলো দেখেছি সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বোঝার উপায় নেই কোনটা কার ছবি। পাশাপাশি ভাষা শহীদদের ওপর লেখা ইতিহাসের বইগুলোও নেই।

তারা আরও জানান, রফিক স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের ভেতরেও কিছু দেখতে পেলাম না। বই বলতে উপন্যাস ও গল্পের বই বেশি। মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই এখানে অপ্রতুল। অন্যান্য ভাষাশহীদকে নিয়ে লেখা কোনো বই সেখানে নেই। যার ফলে সেখানকার নতুন প্রজন্ম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তেমন অবগত হতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে অগণিত পাঠকদের। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস জানার জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই খুবই জরুরি।

শহীদ রফিক স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন খানও স্বীকার করলেন অব্যবস্থাপনার কথা। তিনি বলেন, জাদুঘরে রফিকের কোনো স্মৃতিই নেই। আমি জেনেছি শহীদ রফিকের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র তার ছোট ভাই খোরশেদ আলমের কাছে রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বলেছি জিনিসপত্রগুলো জাদুঘরে আনার জন্য।

গ্রন্থাগারের বই সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন খান বলেন, এখানে প্রায় সাড়ে ১০ হাজারের মতো বই আছে। তবে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ইতিহাসসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বইয়ের জন্য আমি আবেদন করেছি।

এসব বিষয়ে কথা হলে শহীদ রফিকের ভাই খোরশেদ আলম বলেন, রফিকের স্মৃতিচিহ্ন বলতে যা বোঝায় তা খুব একটা নেই। একটি পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, টেবিল-চেয়ার ও কাপড়ের ওপর রফিকের নিজ হাতে নকশা করা একটি টেবিল ক্লথ আছে। জাদুঘরে সংরক্ষণের অভাবে তা দেয়া হয়নি।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহী উদ্দিন বলেন, রফিকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র জাদুঘরে দেয়ার জন্য পরিবারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। যদিও তার ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও দেয়া হয়নি। পরিবার দিলে তা যথাযথ মর্যাদায় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে।