• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

হরিরামপুরের যুদ্ধ: গ্রেনেডে ঝলসে যান মাহফুজুর রহমান

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৪ মার্চ ২০২২  

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে একাত্তরের ১৩ অক্টোবর সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছোড়া গ্রেনেডে ঝলসে যান মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান খান। তিনদিন পর তার মৃত্যু হয়। স্বাধীনতার পঞ্চশ বছর পরও হারিরামপুর উপজেলার এই কৃতী সন্তানের স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন এলাকাবাসী।  

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তার বোনের বরাতে জানা যায়, মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার বলড়া ইউনিয়নের পিপুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মাহফুজুর রহমান খান। বাবা মৃত জিয়াউল হক, মা মৃত শামছুন্নাহার খানম। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাহফুজুর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। জন্ম তারিখটা কেউ সঠিকভাবে জানাতে না পারলেও ২০১১ সালের প্রদত্ত জন্মসনদ অনুযায়ী তিনি ১৯৫২ সালের ১৪ অগাস্ট হরিরামপুর উপজেলার পিপুলিয়া গ্রামে জম্মগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জের হরিণা যুদ্ধের রণাঙ্গনে গুরুতর আহত হন। ১৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অসামান্য বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জনকারী এই বীর যোদ্ধাকে ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে।

সরেজমিনে পিপুলিয়া গ্রামের বাড়ি গিয়ে জরাজীর্ণ টিনের চৌচালার একটি ঘর দেখা যায়। ঘরের বেড়াগুলো অনেক পুরোনো ও বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা। একটু বৃষ্টি হলেই চালের পুরোনো টিনগুলো ভেদ করে ঘরের ভেতর পানি ঢোকে। এই ঘরেই বাস করেন মাহফুজের ছোট বোন শামীমা খানম। ঘরটির সঙ্গেই রয়েছে একটি ছোট্ট ঝুপরি ঘর। ঘরের পাশেই গাছে টানানো রয়েছে মাহফুজুর রহমানের পরিচিতির একটি  ভাঙা সাইনবোর্ড। তাতে নাম উল্লেখ করা হয় ‘মাহফুজুর রহমান মাহফুজ’। তবে স্থানীয়রা তাকে মাহফুজুর রহমান খান নামেই জানেন; এমনকি এই নামেই তিনি গেজেটভুক্ত। টানানো বোর্ডটিতে বাবা-মায়ের নাম পরিষ্কার বুঝা গেলেও জন্ম ও মৃত্যু তারিখের জায়গাটুকু অনেকটা ভেঙে যাওয়ায় তা স্পষ্ট বুঝা যায় না। এই বাড়িতে শহীদ মাহফুজের ছোট বোন ও ভগ্নিপতি থাকেন। তবে মাহফুজুর রহমান যে ঘরে থাকতেন সে ঘরটি এখন আর নেই।

শহীদ মাহফুজুর রহমান খানের ছোটবোন শামীমা খানম বলেন, "আমি আমার ভাইকে দেখিনি। এই দেশের জন্য আমার ভাই জীবন দিয়েছেন। স্বাধীনতার এত বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু এই বাড়িটির খোঁজখবর কেউ রাখেনি।"
স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা ‘একাত্তরের বীরযোদ্ধা খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড ও স্থানীয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, শহীদ মাহফুজুর রহমান খান ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দ্বিতীয় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।


সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারান মাহফুজুর রহমান ১৯৭১ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জের হরিণায় সিও কার্যালয়ে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। একাত্তরের ১৩ অক্টোবর মাহফুজুর রহমান খানসহ  মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সিও কার্যালয় আক্রমণ করে।  প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ওয়্যারলেস স্টেশনে থাকা পাকিস্তানিরা ওয়ারলেস অফিসে ঢুকে পড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ওয়্যারলেস অফিস ধ্বংস করতে যায়। তখন পাকিস্তানিদের ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে মাহফুজুর রহমান খানের পুরো শরীর আগুনে ঝলসে যায়। দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ বলেন, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে তার পিপুলিয়ার বাড়িটিতে মাহফুজের নামে একটি স্মৃতি-পাঠাগার স্থাপন করা এলাকাবাসীর দাবি এবং অবিলম্বে তা বাস্তবায়ন করা হোক।

হরিরামপুরের সন্তান আইন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব তৈয়বুল আজহার বলেন, "হরিরামপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীর প্রতীক শহীদ মাহফুজুর রহমান অনন্য একটি নাম। দেশের স্বাধীনতার জন্য তার আত্মত্যাগ এ দেশের মানুষকে যুগে যুগে অনুপ্রেরণা যোগাবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে, বিশেষ করে হরিরামপুরে আমার জানা মতে তার আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ আমরা নির্মাণ করতে পারিনি।
”স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির এ সূর্য সন্তানের স্মরণে হরিরামপুরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ বালিরটেক সেতুর নামকরণ শহীদ মাহফুজের নামে নামকনণ হোক – তরুণ প্রজন্মের এমনটাই দাবি,” যোগ করেন তৈয়বুল আজহার।

মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সদস্য সচিব মামুন চৌধুরী বলেন, "আমাদের দুর্ভাগ্য যে জেলার অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অকুতোভয় মুক্তিসেনা, বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত শহীদ মাহফুজুর রহমান খানের নামই হয়ত জানে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও এ নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এ অঞ্চলের প্রজন্মের কাছে মাহফুজুর রহমান খানের নাম অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে, যা মানিকগঞ্জবাসীর জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।

”আমি মনে করি, এই বীর প্রতীকের হরিরামপুরের বাড়িটি সংরক্ষণ করে একটি মিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি করে শহীদ মাহফুজসহ হরিরামপুর তথা জেলার অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।"

হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ হাসান ইমাম বাবু বলেন, "মাহফুজ অত্যন্ত সাহসী এবং সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন। তৎকালীন হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জের হরিণায় এক অপারেশনে তিনি শহীদ হন। আমি বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীর ওপর সেতুটির নামকরণ মাহফুজের নামে করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাই।”
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার লিয়াকত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ২৬ মার্চ আত্মগোপনে গেলে তার চলাচল ও অবস্থান যারা জানতেন তাদের তিন থেকে চার জনের একজন ছিল মাহ্ফুজ। যুদ্ধ শুরু থেকে শহীদ হওয়া পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। মাহফুজ একজন সাহসী মানুষ।” 

মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “আমি আর মাহফুজ একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি।” জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দ্রুত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মাহফুজের নামে হরিরামপুরে স্মৃতিস্তম্ভ করা হবে বলে জানান তিনি।