• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জীবনের তাগিদে যাত্রাপালা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় মানিকগঞ্জের যাত্রাশিল্প

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩  

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার বরঙ্গাইল গ্রামের যাত্রাশিল্পী সাদ্দাত হোসেন। যাত্রামঞ্চে অভিনয় করতেন জল্লাদের। নিজ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করেছেন অভিনয়। তবে, কয়েক বছর ধরে যাত্রাপালার অনুমতি না পাওয়ায় জীবনের তাগিদে ধরেছেন অটোরিকশার হ্যান্ডেল। মঞ্চ কাপানো সাদ্দাত এখন অটোরিকশা দিয়েই সংসার চালাচ্ছেন।

শুধু সাদ্দাত হোসেনই নন, তার মত প্রায় ৫শতাধিক যাত্রাশিল্পী কাজ না থাকায় এদের মধ্যে অনেকেই এখন চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়। কেউ করছেন চায়ের দোকান, আবার কেউ চালাচ্ছেন রিকশা, ভ্যান, কেউবা করছেন দিনমজুরের কাজ। মঞ্চে সরব এসব মানুষগুলো এখন অভাবের যাঁতাকলে পিষ্ট বলেই এমন পেশায় জড়িয়েছেন।

যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা ইউসুফ হোসেন জানান, ‘আমার আয়ের প্রধান উৎসই ছিলো যাত্রাপালায় অভিনয় করা। জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেছে যাত্রাপালায় অভিনয় করে। তাই আর অন্যকোন কাজ ভালোভাবে শেখা হয়নি। আমার নিজের একটা যাত্রাদলও আছে কিন্তু এখন আর আগের মত ডাকপাইনা। কারণ কিছু মৌসুমী শিল্পীদের অশ্লীল নাচ এবং অভিনয়ের কারণে যাত্রাশিল্পের এমন দশা হয়েছে। সেই সকল মৌসুমী শিল্পীদের কারণেই মাসুল গুণতে হচ্ছে পেশাদার শিল্পীদের। এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ না নিলে যাত্রার হারানো ঐতিহ্য আর ফেরানো সম্ভব হবে না।’

দুই যুগেরও বেশি সময় মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বড় বড় যাত্রাদলে অভিনয় করেছেন যাত্রাশিল্পী রাজ্জাক। সেসময় অভিনয় করে কামিয়েছিলেন ভালো টাকা। তখন সংসারে অভাবও ছিলো না। কিন্তু পাঁচ-সাত বছর ধরে আগেরমত এখন আর যাত্রাপালা নেই। তাই আয় রোজগার না থাকায় নিজের পরিবার বাঁচাতে বাধ্য হয়েই রিকশা চালাতে হচ্ছে তাকে।

যাত্রাশিল্পী রেজিয়ার সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘মানিকগঞ্জের যাত্রাপালার কদর অনেক আগে থেকেই রয়েছে। সেই সুবাদে আগে অনেক কাজ ছিলো। বছরের অর্ধেকের বেশি সময়ই আমরা ব্যস্ত থাকতাম দেশের নানান জায়গায় পালা করে। কিন্তু এখন আর আগের মত কাজ নাই আর বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকতে হয়। খুব কষ্টে জীবন পাড় করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে যখন দেখি আমার সহকর্মীরা দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান বা চায়ের দোকানে কাজ করছেন।’

বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মো. আলী আব্বাস জানান, ‘যারা যাত্রাপালার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে জড়িত তারা এই কাজটাই ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। অন্যকাজ তারা করতে পারেনা বা শিখেনি। দেশে করোনা আসার পর থেকে প্রায় দুই বছরের জন্য জনসমাগম ও মেলা নিষিদ্ধ করায় যাত্রাপালা বন্ধ হয়ে যায়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও সরকার যাত্রাপালা করার অনুমতি কম দিচ্ছে যার কারণে যাত্রাশিল্পীরা পেটের তাগিদে বিভিন্ন কাজে চলে গেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘একসময় জেলায় ২১টি যাত্রাদল থাকলেও এখন নামমাত্র টিকে আছে ১১টি দল। মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার যাত্রাশিল্প এখন মুখ থুবরে পড়েছে। যেহেতু এটা দেশের ঐতিহ্যের সাথে জড়িত তাই পুরোদমে যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করার অনুমতিসহ যাত্রাশিল্পকে উন্নয়ন করার জন্য সরকারের নানা পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে দেশে সকল প্রকার গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকার কারণে কোন যাত্রাপালার অনুমতি পায়নি যাত্রাদলগুলো।

বর্তমানে অনুমতি না পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, আগে যে ধরনের যাত্রা মঞ্চস্থ করা হতো এখন সেই ধরণের পালা থেকে বের হয়ে অধিকাংশ যাত্রাদল অশ্লীলতার দিকে ঝুঁকেছে। এ ধরণের যাত্রাপালা মানুষজন ভালোভাবে নেয়না তাই অনেক কিছু বিবেচনা করেই আমাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’

প্রকৃতপক্ষে যাত্রার যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মানিকগঞ্জে রয়েছে সেসকল মান বজায় রেখে সুস্থ ধারার যাত্রাপালা করলে অব্যশই তাদেরকে অনুমতি দেয়া হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

গ্রাম বাংলার ঐহিত্যবাহী এই যাত্রাশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন যাত্রাশিল্পীরা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যাত্রা শিল্পে আবারও প্রাণ ফিরবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় শিল্পীদের।