• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দল যার যার, মাশরাফি সবার

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮  

‘দেখে যাওয়া’ ও ‘দেখিয়ে দেওয়া’- তারুণ্যের দু’মুখো এই সরণিতে ক’জনই-বা চ্যালেঞ্জ নিতে জানে! ক’জন ঠিক বা বেঠিকের প্রায়োগিক সীমা ছাড়িয়ে তারুণ্যের আগুন জ্বালাতে পারে! স্বার্থ ও পরার্থের যোগপদ্য ছাপিয়ে যে ক’জন এখনও মঙ্গলদীপ জ্বালাতে চান, তাদেরই একজন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্রিকেটের বৃত্তের মধ্যে থেকেও তিনি এখন রাজনীতির সাহসী সরণিতে। গ্যালারির চিৎকার তিনি অনেক শুনেছেন, পুরস্কার মঞ্চ থেকে বহু ট্রফি হাতে নিয়েছেন; কিন্তু দেবীতলার কোনো গৃহস্থের উঠানে গিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া মিষ্টির প্লেট কিংবা নিজের বাগান থেকে তুলে আনা কোনো কিশোরের ফুলের তোড়া- পবিত্র এই ভালোবাসার স্পর্শ তিনি পেয়েছেন এবার নড়াইল গিয়ে নির্বাচনী প্রচারের সময়। ফেসবুকের ঠুনকো জগতের বাইরে মাটি আর নদীর কাছে গিয়ে তিনি অনুভব করেছেন, দল-মত নির্বিশেষে খাঁটি ভালোবাসা মিশে আছে প্রান্তিক মানুষের কাছেই। নড়াইল-২ আসনে নৌকার প্রার্থী মাশরাফি, সকাল থেকে রাত অবধি নড়াইলের প্রতিটি জনপদে ছুটে বেড়াচ্ছেন। তার এই নবযাত্রার সঙ্গী আওয়ামী লীগ সমর্থক বা কর্মীরাই শুধু নয়, ভিন্ন রাজনীতির মানুষও রয়েছেন সরবে-নীরবে। ‘মাশরাফি নড়াইলের গর্বিত সন্তান এবং সে ভালো ছেলে। আমরা দল-মত নির্বিশেষে মাশরাফির জন্য কাজ করছি। দল যার যার, মাশরাফি আমাদের সবার।’

বক্তার নাম খন্দকার সাদিয়ার রহমান, নড়াইল জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক।

তার বলা এই বার্তাটিই যেন প্রচার করতে চাইছেন মাশরাফি। প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থী সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখেই সমর্থকদের কাছে আবেদন তার- ওদের ওপর যেন মানসিক কিংবা শারীরিক কোনো আঘাত না হয়। শহরের দুর্গাপুর অফিসে নৌকার প্রতীকে আলোকসজ্জা করায় কিছুদিন আগে নির্বাচনী নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। ঢাকা থেকে ফোন করে মাশরাফি তার সমর্থকদের পরিস্কার বলে দিয়েছেন- এমন যেন না হয়। তারপরই শহরের সব ল্যাম্পপোস্ট থেকে তার নির্বাচনী পোস্টার তুলে ফেলেন নড়াইল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা।

নড়াইল শহরকে প্রজন্মের সেরা  বাসস্থান বানানোর স্বপ্ন মাশরাফির। এরই মধ্যে নিজ উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর তার মা হামিদা মুর্তজা সমর্থকদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে ঝাড়ূ দিয়েছেন। নির্বাচনে জিতলে পরে কী করবেন- এমন প্রশ্নের কোনো গালভরা প্রতিশ্রুতি তিনি দিচ্ছেন না। রাজনীতির চেনা পথেও হাঁটতে চান না তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ- এই তিন মন্ত্র নিয়েই তার রাজনীতিতে পা রাখা। তার উপস্থিতিতে নড়াইলে তরুণদের মধ্যে একটি নবজাগরণ শুরু হয়েছে ঠিকই; কিন্তু মাশরাফি চান মুরব্বিদের দোয়া এবং পরামর্শ নিয়েই স্বপ্নের নড়াইল গড়তে। আর এ জন্য প্রথম যখন মনোনয়ন পাওয়ার খবর শোনেন, তখন নড়াইলের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও পরে তারাই মাশরাফিকে আশ্বস্ত করেন, ‘তুমি তোমার খেলা চালিয়ে যাও, এখানে আমরা নির্বাচনী প্রচার করব।’ মাশরাফির এই নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো টাকা খরচ করতে দিচ্ছেন না তারা। ‘মাশরাফি একজন সৎ, দেশপ্রেমিক ছেলে। তার জন্য ভোট চাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে অর্থের লেনদেন করে আমরা কলুষিত হতে চাই না। টাকা ছাড়াও ভোট হয়, সেটা শতভাগ ভোট দিয়ে প্রমাণ করব আমরা।’ মুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ অধিকারী মনে করেন, বিপুল ভোটে জিতবে তাদের ঘরের ছেলে মাশরাফি। “এখন মাশরাফি শুধু আমার সন্তান নয়, ও নড়াইলের সন্তান, পুরো দেশের সন্তান। অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে সরাসরি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছিল সে। মাঝে অনূর্ধ্ব-১৯ কিংবা ‘এ’ দলে খেলতে হয়নি তাকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, রাজনীতিতেও সরাসরি সাংসদ প্রার্থী মাশরাফি। আমার বিশ্বাস, জাতীয় দলে যেভাবে আস্থার প্রতিদান দিয়েছে, রাজনীতিতেও তেমনই ভূমিকা রাখতে পারবে সে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আস্থা রেখেছেন, সেই আস্থার মর্যাদা রাখতে পারবে মাশরাফি।” বাবা গোলাম মুর্তজা স্বপনের এখন ব্যস্ত সময় কাটছে।

স্বতঃস্ম্ফূর্ত প্রচার :নড়াইল সদর আর লোহাগড়ার ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে মাশরাফির নির্বাচনী এলাকা। ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৭ হাজার ৫১১। এই আসন বরাবরই নৌকার ঘাঁটি। ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং সর্বশেষ ২০১৪ নির্বাচনে নৌকা ও তার সমর্থনের প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এবারও মাশরাফির জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস ও সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান। মাশরাফির হয়ে প্রচারে নেমেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট এস এ মতিনের নেতৃত্বে সচেতন নাগরিক সমাজ নামে একটি সংগঠন। এর বাইরেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে প্রচারে নেমেছেন প্রিয় মাশরাফির জন্য। নড়াইল কাঁচাবাজারের হোটেল ব্যবসায়ী ইসহাক হোসেন ও তার তিন কর্মচারী মিলে বাঁশের কঞ্চি আর লাল-সবুজের কাপড় দিয়ে তৈরি করেছেন ৩০০ নৌকার রেপ্লিকা। মহিষখোলা কাঁচাবাজারের ফল বিক্রেতা মুন্নু মোল্লা, সবজি বিক্রেতা মোবারক মোল্লা, মুদি দোকানি সাঈদুল ইসলাম তাদের ব্যবসার সময় কমিয়ে মাশরাফির জন্য প্রচারণায় নেমেছেন। জেলা ইজিবাইক শ্রমিক সমিতির সভাপতি লায়েব আলী নিজ খরচে তার প্রচার চালাচ্ছেন। মাশরাফির জন্য গান বেঁধেছেন মূর্ছনা সঙ্গীত নিকেতনের শিল্পীরা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শিল্পীরা ‘ষড়ঋপুর শবযাত্রা’ নামে একটি গীতিনাট্য তৈরি করেছেন মাশরাফিকে নিয়ে। জেলার ৬৮টি ক্লাবের কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়রা দিনভর প্রচার চালাচ্ছেন মাশরাফির জন্য। শুধু নড়াইল নয়, বগুড়া ও সিলেট থেকেও মাশরাফির সমর্থকরা এসে নৌকার প্রচার করছেন। ক্রিকেটার বন্ধু সৈয়দ রাসেলও এসেছেন যশোর থেকে তার প্রচারণায়।

নড়াইল সদর না লোহাগড়া :তবে নড়াইল ফাউন্ডেশনের তরুণ কর্মীদের চ্যালেঞ্জ এখন একটিতেই, আর তা হলো মাশরাফি তার নিজের জন্মস্থান নড়াইল সদর থেকে বেশি ভোট পাবেন, নাকি তার শ্বশুরবাড়ি লোহাগড়া থেকে বেশি ভোট পাবেন- তা নিয়ে। এরই মধ্যে মাশরাফির স্ত্রী সুমনা হক সুমি লোহাগড়ায় বিভিন্ন উঠান বৈঠকে নারী ভোটারদের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। স্বামীর রাজনীতিতে নামা নিয়ে শুরুতে তার মধ্যে শঙ্কা কাজ করলেও এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন- মানুষকে বিনোদন দিয়ে হাততালি পাওয়া থেকেও বেশি আনন্দ মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে। মাশরাফি বিন মুর্তজা এখন সেটিই করতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম কেনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে কিছু তথাকথিত সুশীলের দল মিলে কম সমালোচনা করেনি মাশরাফিকে নিয়ে। খেলা না ছেড়ে কেন নির্বাচনে? মানুষের পয়সায় গড়া জাতীয় দল, সেই দলের সদস্য হয়ে কেন তিনি নৌকায় দাঁড়ালেন? মাশরাফি জানেন, সবার মুখ তিনি বন্ধ করতে পারবেন না। তিনি এটাও জানেন, যারা বলছে তারা বলেই যাবে। ‘আমি নড়াইলের সন্তান, নড়াইলের জন্য কাজ করতে চাই। আপাতত এটুকুতেই সীমাবদ্ধ আমার লক্ষ্য। আমার এলাকার বাইরে যারা, অন্য মতাদর্শে বিশ্বাসী যারা, তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা, এটাই হয়তো আমাদের সংস্কৃতি। তবে রাজনীতিতে আসার পর আমার মন আরও শক্ত হয়েছে। আমি মনে করি, যে মানুষগুলো কষ্টে আছে, সুবিধাবঞ্চিত, তাদের কাছে যাওয়ার একমাত্র উপায় রাজনীতিতে আসা। এককভাবে তাদের জন্য কতটুকুই-বা করা যায়। আমি হয়তো এসিরুমে বসে একে গালি দিচ্ছি, ওকে উড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ভাই, মাঠে আসেন। বাস্তবতা দেখেন, হাজার হাজার মানুষ সুবিধাবঞ্চিত। আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই, আমি এই চ্যালেঞ্জটা নিতে চাই।’ মাশরাফির ইচ্ছা, তথ্যপ্রযুক্তির একটি হাব গড়ে তুলবেন তিনি নড়াইলে।

প্রতিপক্ষের ভাবনা :যে শেকড় তাকে ‘কৌশিক’ থেকে ‘মাশরাফি বিন মুর্তজা’ বানিয়েছে, সেই প্রতিদান তিনি দেবেন। জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও প্রতিপক্ষ প্রার্থী সম্পর্কে নিশ্চিন্ত-নির্ভার থাকতে রাজি নন তিনি। খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই শেখা- প্রতিপক্ষকে কখনও হালকাভাবে দেখতে নেই। সমকালের নড়াইল প্রতিনিধি শামীমুল ইসলাম জানান, ২০ দলীয় জোটের শরিক এনপিপির চেয়ারম্যান এ জেড এম ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। তার বাড়ি লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের করফা গ্রামে। থাকেন ঢাকায়। এলাকার তেমন কোনো সামাজিকতার সঙ্গে জড়িত নন। এমনকি নতুন প্রজন্ম তাকে চেনেও না। এ ছাড়া তার দল এনপিপির কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও তাকে এবং তার কর্মী বাহিনীকে তেমন একটা মাঠে দেখা যাচ্ছে না; বরং বিএনপির অনেক নেতাকর্মী গোপনে মাশরাফির পক্ষে ভোট চাইছেন। জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নড়াইল-১ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে বেশি কাজ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জোটের প্রার্থী বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ রক্ষা করছেন না এবং নির্বাচনী কাজে অর্থব্যয় করছেন না। প্রচারণা না চালানোর জন্য যদিও এসব কারণ মানছেন না ফরিদুজ্জামান; বরং তার অভিযোগের আঙুল মাশরাফির দিকেই। গত সোমবার প্রচারণা চালানোর সময় তার কর্মীদের ওপর হামলায় ১০ জন আহত হয়েছে। ‘মোটরসাইকেল ভাংচুরসহ আমাদের কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। এর দায় মাশরাফি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’ ব্যাপারটি নিয়ে মাশরাফির মধ্যেও কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। বারবার তিনি তার অহিংস রাজনীতির প্রচার করে যাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন নির্বাচনী বহর কমিয়ে আনতে। কিন্তু তার উপস্থিতিতে যে জোয়ার দেখা দিয়েছে চিত্রা নদীর পাড়ে, সেই জোয়ারের ধাক্কা কিছুটা পাড় ভাঙবে বৈকি।