• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

একতরফা ভোট: ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে সরব আ. লীগ, চুপ বিএনপি

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে মোট তিনটি। এর মধ্যে সবচেয়ে কম টিকেছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটে ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকার।

ভোট শেষে সংসদ বসে ১৯ মার্চ। সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র চার কার্যদিবস। সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র ১২ দিন।

বিএনপি সরকারের পতনের পর ওই বছরের ১২ জুন আরও একটি নির্বাচন হয়। আর তাতে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

ওই নির্বাচনের ২৫ বছর পূর্তির দিন নানা কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি সেই নির্বাচনকে স্মরণ করেনি। নির্বাচন নিয়ে জানতে চাওয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নাখোশ হয়েছেন।

সে সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জন, আন্দোলন, প্রতিরোধের মুখে এই নির্বাচন ঠেকানো নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। ২২টি নির্বাচনি এলাকায় ভোটও করা যায়নি। বাকিগুলোতেও হাজার হাজার কেন্দ্রে ব্যালট পাঠালেও তা ছিনিয়ে নেয়া হয়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় বহু মানুষ।

এর আগে ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জন আর ২০১৪ সালে বিএনপি ও জামায়াতসহ সমমনা আরও বেশ কিছু দলের বর্জনের মধ্যে নির্বাচন হয়েছে।

তবে এই তিন নির্বাচনের মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের কোনো তথ্য পাওয়া কঠিন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও সমমনারা যেমন অনেক কথা বলেন, তেমনি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনেক আক্রমণাত্মক কথা বলেন। কিন্তু নিজেদের আমলের একতরফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুই দলের যুক্তি একই, সংবিধান রক্ষা।

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ। আন্দোলনে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীও।

কিন্তু দাবি না মেনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। বিএনপি ছাড়া মূলধারার আর কোনো দল ভোটে অংশ না নিলেও নতুন, অপরিচিত বহু দল নেই ভোটে আসে। এর একটির নাম ছিল ‘জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ’।

 

একতরফা ভোট: ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে সরব আ. লীগ, চুপ বিএনপি

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের স্মরণে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশ

 

বিএনপির কর্মী-সমর্থকরাই সে সময় এই দলটি গড়ে তুলেছিলেন বলে প্রচার আছে। এখন আর সেই দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

সে সময় অবশ্য সব আসনে ভোট করা যায়নি। বেশ কিছু আসন ফাঁকা রেখেই গঠন করা হয় সংসদ। বাকি আসনগুলোর মধ্যে বিএনপি পায় ২৭৮টি।

ওই নির্বাচনে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টি। সে সময়ের কুমিল্লা-৬ আসন থেকে জিতিয়ে আনা হয় বঙ্গবন্ধুর খুনি শাহরিয়ার রশিদকে। বিএনপির ইচ্ছা ছাড়া এটা অসম্ভব ছিল তখন।

যা হয়েছিল তৃণমূলে

১৯৯৬ সালের ওই নির্বাচনের আগের ও নির্বাচনের দিনের স্মৃতিচারণ করে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, ‘তখন আমি ছাত্রলীগ করি। আমরা নেতা-কর্মীরা এমন নির্বাচন মেনে না নিয়ে আন্দোলন শুরু করি। ভোটের আগের দিন রাত অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে কুমিল্লা মর্ডান স্কুল সংলগ্ন নির্বাচন অফিসে হামলার প্রস্তুতি নেই। তবে সে সময় পুলিশি বাধার মুখে আর পারিনি।

‘১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ভোট বন্ধ করতে আমরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে হাজির হই। আমি আমার নেতা-কর্মীদের নিয়ে নগরীর অন্তত ১৫টি কেন্দ্র থেকে ৪০ টি ব্যালেট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যাই।’

তিনি বলেন, ‘সে সময় কোনো ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যায়নি। তারা দূর থেকে আমাদের কাজকর্ম দেখছিল। আমরা যখন কেন্দ্র ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে চলে আসি, তখন তারা হাততালি দিয়ে আমাদের কার্যক্রমকে স্বাগত জানায়।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাই বাবলুও তখন ছিলেন ছাত্রনেতা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের দিন পুরো কুমিল্লা নগরী তখন থমথমে অবস্থা ছিল। আমরা সকল উপজেলার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলাম যে কোন মূল্যে এই নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা এক হই।’

তিনি বলেন, ‘আমি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নে অবস্থান নেই। সেখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাস্তা কেটে দেই।

‘আমাদের ভূমিকা দেখে অনেক প্রিসাইডিং অফিসার ব্যালট পেপার ফেলে পালিয়ে যায়। নির্বাচনের আগে থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতেও পাতানো নির্বাচন বন্ধে আমাদের ছাত্রলীগের সক্রিয় অবস্থান ছিল।’

কিশোরগঞ্জ সদর আসনের সেদিন ভোটের চিত্র কেমন ছিল, তা জানিয়েছেন সে সময়ের বিরোধী দলে থাকা বর্তমানে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ সাদী।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন প্রতিহত করতে আমরা কিশোরগঞ্জে লাগাতার হরতাল, অবরোধসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকি। সে সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরা ছিলেন অফিস ও ঘরমুখী।’

সদর আসনে সে সময়ে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মাসুদ হিলালী। বিএনপিরই নেতা অসীম সরকার বাঁধন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান ঘুড়ি প্রতীকে। হাতি প্রতীকে ছিলেন দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত সরকারি কর্মকর্তা মো. ইউসুফ।

শরীফ সাদী বলেন, ‘ভোটের আগের রাতে আওয়ামী লীগ নেতা দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামাল ও সাব্বির আহমেদ মানিকের বাসা থেকে কর্মীদেরকে নির্বাচন বানচালের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়।

‘আগের রাতে প্রতিটি কেন্দ্রের পাশে নেতাকর্মীদেরকে বাউল গানসহ নানা সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সজাগ থাকা এবং পরদিন সকাল থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়া হয়।

‘ভোটের দিন বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট বাক্স ও নির্বাচনি সরঞ্জাম ছিনিয়ে নিয়ে আসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেদিন কোনো ভোটার ভোট কেন্দ্রে যায়নি। সদর উপজেলার বিন্নাটি ও মারিয়া এলাকায় দুটি কেন্দ্রে ব্যাপক গোলযোগ হয়।

‘মারিয়ার কামালিয়ারচর কেন্দ্রে নির্বাচন বানচাল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আওয়ামী লীগ কর্মী সোহরাব। গুলিবিদ্ধ হ ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মঞ্জু মিয়া ও মাদ্রাসার ছাত্র আসাদ।’

সে সময়ের জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নেতৃত্বে শহরের খড়মপট্টি এলাকায় জেলা নির্বাচন অফিসে হামলা হয।

নেতা-কর্মীরা নির্বাচনি সরঞ্জামে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সদর আসনের পাশাপাশি পাকুন্দিয়ায়ও তুমুল আন্দোলন হয়। সে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ মিয়া ও সে সময়ের তরুণ নেতা রফিকুল ইসলাম রেণু। তাদের নেতৃত্বে পাকুন্দিয়ায় নির্বাচনি অফিসে আগুন দেয়া হয়।

নির্বাচনে যাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, তারা সংসদে গিয়েছিলেন অ্যাম্বুলেন্সে করে।

তথ্য নেই নির্বাচন কমিশনের কাছেই

বাংলাদশে সব জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকলেও এই একটি নির্বাচন নিয়ে কোনো তথ্য নেই সেখানে।

কেন নেই তার কোনো ব্যাখ্যাও নেই নির্বাচন কমিশনের কাছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ করে কোনো কথাও বলতে চান না নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটার কোনো প্রতিবেদন নেই। এটার তথ্য সেভাবে পাবেন না।’

ওই কর্মকর্তার মতে, সে সময়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সে কারণেই নির্বাচনের তথ্য সংরক্ষণ করা যায়নি।

 

একতরফা ভোট: ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে সরব আ. লীগ, চুপ বিএনপি

সে সময়ের নির্বাচন কমিশনার এ কে এম সাদেক

 

তিনি বলেন, ‘ওই সময় অনেক কিছু ভাঙচুর, কমিশনে পরিবর্তন- তখন আর ওই নির্বাচন প্রতিবেদন করা হয়ে উঠেনি। মূল কথা, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে রিপোর্টটি করা হয়নি।'

কোনো সঠিক হিসাব না থাকলেও ধারণা করা হয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিলো ২০ থেকে ২১ ভাগ। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক।

কী বলছে আওয়ামী লীগ

ওই নির্বাচনের ২৫ বছর পূর্তির দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। সেদিন আন্দোলনে অনেক নেতা-কর্মীকেও জীবন দিতে হয়েছে।’

তিনি বলেন ‘কোনো রাজনৈতিক দল এতে অংশগ্রহণ করেনি, সে কয়েকটি দল গঠন করে করেছিল, দুই পারসেন্ট ভোটও পড়েনি।

‘সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ডিপ্লয় করে দিয়ে জনগণের ভোট চুরি করে। ভোট চুরি করে আবার তিনি (খালেদা জিয়া) প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু তা মেনে নেয়নি। তীব্র আন্দোলন হয়। সে আন্দোলনের মধ্যে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন।’

 

একতরফা ভোট: ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে সরব আ. লীগ, চুপ বিএনপি

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের স্মরণে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশের একাংশ

 

১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে প্রহসনমুলক আখ্যা দিয়ে সোমবার রাজধানীতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন।

ওই নির্বাচনের স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদকে বসিয়ে সংসদকে কলঙ্কিত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র বিএনপির হাতে বিকৃত হয়। শিক্ষা-দিক্ষা সহকিছুই তাদের হাতে বিকৃত রুপ লাভ করে। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে লাভ হবে না।‘

স্মৃতিচারণ করতে বলায় ক্ষেপলেন বিএনপির নজরুল ইসলাম খান

এ নির্বাচনকে কোনো ভাবেই কলঙ্কিত মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা তো নির্বাচন দিয়েছিলাম সেটা যেমনই হোক৷ আওয়ামী সরকার কী করছে? এক যুগ ধরে তো বসেই আছে। জনগণ কী চায় তা মাথাতেই নিচ্ছে না।’

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিরক্তি প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি উল্টো নিউজবাংলার কাছে জানতে চান, ‘এতদিন পরে কেন এ প্রসঙ্গ?’

তিনি বলেন, ‘এত বছর এসে আপনাদের এখনও কমেন্টের কী দরকার আমি আসলে বুঝি না। আমি ঐ ইলেকশন করিনি। যারা করছেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন।’