• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন নামে রাজনীতিতে ফিরতে মরিয়া জামায়াত

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

বেশ কিছু দিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছিলো যে, রাজনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত অবস্থান, সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনায় জনগণের কাছে অগ্রণযোগ্য হয়ে রাজনীতির কক্ষপথ থেকে ছিটকে গিয়েছে জামায়াত। তাই এবার স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন রূপে দেশের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করছে দলটি। প্রত্যাবর্তনের অংশ হিসেবে এবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সূত্র বলছে, সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। যদিও বিষয়টি দলের মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি। ২০-দলীয় জোটে না থাকার সিদ্ধান্তে প্রায় সবাই একমত। এদিকে জামায়াতের ২০ দল থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্তে জোটের শরীক দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। কারণ ২০ দলীয় জোটের স্ট্রাইকিং দল হিসেবে জামায়াতকে বিবেচনা করা হতো। সংকটময় মুহূর্তে জামায়াতের এমন সিদ্ধান্তে ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বাড়াবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

জামায়াতের শুরা কমিটির সূত্রের বরাতে জানা যায়, দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ বড় ধরনের পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে। এই অংশ ৭১ সালের ভুল স্বীকার করে বর্তমান নামে দলকে সচল রাখতে অথবা নতুন নামে দল গঠন করতে চায়। জানা গেছে, প্রায় ৯ বছর আগে অনেকটা একই রকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন পর কারাগার থেকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রস্তাব করেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দায়িত্বশীলদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতের নামও বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারসহ তখনকার জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাধার কারণে সেটা আর এগোয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের তরুণ নেতৃত্বের একটি অংশ নতুন করে ওই প্রস্তাব ও আলোচনা সামনে এনেছে।

জামায়াতের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয়। দলের তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে সভায় একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি। সেখানে ২০-দলীয় জোটে আর না থাকা ও কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রায় সবাই একমত হন।

দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা বলছেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকায় দলটির নেতা-কর্মীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীরা কয়েক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দলের বেগতিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রবীণ নেতারা গঠনতন্ত্রের একটি ধারা স্থগিত রেখে দলকে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে চান। তারা একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকা মূল্যায়ন করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে সম্মত হয়েছেন। তারা মনে করেন, অতীত অপরাধের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাইলে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে। যদিও একটি অংশ এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেছে। এদিকে, দল বিলুপ্ত করার প্রস্তাব আলোচনায় এলে মতিউর রহমান নিজামীর ছোট ছেলে নাদিমুর রহমান তালহা এটাকে ‘বেইমানি’ বলে মন্তব্য করেন।

জানা গেছে, সত্তরের দশকের শেষভাগে থেকে যারা ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাদের অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য জামায়াতের ভুল স্বীকার করা উচিত। এই অংশটি মনে করে, একাত্তরে যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের ভুলের দায় আর বহন না করাই উত্তম হবে জামায়াতের জন্য। তারা মনে করেন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ব্যাপক বিজয়ের পর দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক একাত্তরের মূল্যায়ন ও ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার যে প্রস্তাব তুলেছিলেন, তা করা হলে আজ জামায়াতকে জন বিচ্ছিন্ন হতে হতো না।

দলের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, মূলত দলে এই চিন্তার অনুসারী নেতা ও সমর্থকদের বড় একটি অংশ একাত্তরের মূল্যায়ন সম্পন্ন করে জামায়াতে ইসলামীকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার পক্ষে। তারা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জামায়াতকে বিলুপ্ত করার পর নতুন একটি গণতন্ত্র অভিমুখী দল গঠন করে রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব।

দল বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠন করার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াতের বর্তমান রাজনৈতিক ভঙ্গুরতা দেখে অনেকেই বিভিন্ন রকমের প্রস্তাব দিচ্ছেন। সব প্রস্তাব আমরা আমলে নিচ্ছি না। এটি সত্য যে, পূর্ববর্তী নেতৃত্বের হেঁয়ালিপনা, গোঁড়ামির কারণে জামায়াতকে আজ অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে। সময়ের কাজ সময়ে করলে জামায়াতকে আজকে এমন দিন দেখতে হতো না। যাই হোক, অতীতের পরিস্থিতি হয়তো এমন ছিল না যার কারণে তারা ভবিষ্যৎ রাজনীতির আভাস দিয়ে যেতে পারেননি। এখন নতুন দল করার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে। আমরা নতুন রূপে ফিরে এসে রাজনীতিতে চমক দেখাতে চাই।