• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বিতর্কিত অবস্থান পরিবর্তনে ব্যর্থ হওয়ায় পদত্যাগ করলেন জামায়াতনেতা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

শের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে এবং বৈশ্বিক অগ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামীর নাম পরিবর্তন কিংবা দল ভেঙ্গে দিয়ে ইসলামী ধারার নতুন একটি দল গঠন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা শোনা যাচ্ছিল গণমাধ্যমে। এরই মধ্যে কয়েকটি গণমাধ্যম জামায়াতের পুনর্গঠন নিয়ে বিশ্লেষণী সংবাদ পরিবেশন করায় রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছিল। জামায়াতের পুনর্গঠন এবং দল ভেঙ্গে দেয়ার সেই গুঞ্জনকে বাস্তবে রূপ দিলেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তবে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের হঠাৎ এই পদত্যাগকে শুভ দৃষ্টিতে দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিয়ে দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জামায়াত কৌশলে ব্যারিস্টার রাজ্জাককে পদত্যাগ করার নাটক সাজাতে বলেছে। দলের ভেতর কৃত্রিম অবিশ্বাস ও অনাস্থা সৃষ্টি করে সরকার ও জনগণের নার্ভ বোঝার জন্যই ব্যারিস্টার রাজ্জাক এমন রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন। জামায়াতের রাজনীতি বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির বিপরীত হওয়ায় দেশবাসীর সামনে ভুল স্বীকারের খেলা খেলে জামায়াত তাদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই পূর্বক জামায়াতকে নতুন করে রাজনীতির মাঠে নামানোর অংশ হিসেবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক এসব করছেন। তারা এও মনে করেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাক জামায়াতের রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযানের নামে জামায়াতকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় এমনটা করছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ জামায়াতের রাজনীতিকে কলঙ্কমুক্ত করার চেয়ে আরো বেশি সন্দেহ ও ষড়যন্ত্রের আভাস দিচ্ছে।

এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং দল বিলুপ্তির পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
জানা গেছে, আব্দুর রাজ্জাক তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে মূলত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকাকেই তুলে ধরেছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক দাবি করেছেন, একাত্তরের ভূমিকার কারণে দলটি যাতে জাতির কাছ ক্ষমা চায় সেজন্য তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছেন। এই ইস্যুতে তিনি জামায়াতকে বিলুপ্ত করে দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন দলীয় ফোরামে। কিন্তু দলীয় ফোরাম তার কোন প্রস্তাবেই রাজি হয়নি। রাজ্জাক মনে করেন, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সে দাবি অনুযায়ী জামায়াত নিজেকে এখন পর্যন্ত সংস্কার করতে পারেনি। পদত্যাগ পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতৃবৃন্দ ৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেনি। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেনি। অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় এখন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল স্বীকার করে জাতির সাথে সে সময়ের নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার অবস্থান নেওয়া। ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে স্বীকৃতি পায়নি জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সব সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। ’
পদত্যাগপত্রে তিনি বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা ও একাত্তরে দলের ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে যে প্রভাব তা তুলে ধরেছেন দলের আমিরের কাছে। তিনি দাবি করেন, জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর তিনি দলের ভেতর থেকে সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘গত ৩০ বছর আমি সেই চেষ্টাই করেছি। আমি কাঠামোগত সংস্কার ও নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলাম। ২০১৬ সালে চিঠি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। অন্য মুসলিম দেশগুলোর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু কোনও ইতিবাচক সাড়া পাইনি। ’ দলের সর্বশেষ পদক্ষেপ তাকে হতাশ করেছে বলেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত ব্যারিস্টার রাজ্জাক ১৯৮৬ সালে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগকে স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এ আরাফাত বলেন, আমাদের প্রথমেই মনে রাখা উচিত যে, জামায়াত একটি কৌশলী দল। জামায়াত বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে গোপনে-প্রকাশ্যে দেশের স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা বিনষ্টের চেষ্টা করেছে। জামায়াতের রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কলঙ্কজনক অধ্যায়। দেশের অর্জনে নূন্যতম অবদান নেই জামায়াতের। আজকে যখন অতীত কুকর্ম ও ধ্বংসের রাজনীতির জন্য দেশ ও বিদেশে ঘৃণা ও অপমানের শিকার হয়েছে, তখন ব্যারিস্টার রাজ্জাকের মতো নেতারা শুদ্ধ পুরুষ সেজে জামায়াত ত্যাগ করার নাটক করছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে জামায়াত গঠনের স্বপ্নে দলত্যাগ করেছেন, সেই স্বপ্ন কোনদিনই পূরণ হবে না। কারণ জামায়াত পাকিস্তানের আদর্শে পরিচালিত হয়। আর পাকিস্তান কখনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা চাইবে না।
তিনি আরো বলেন, ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে কৌশল অবলম্বন করে জামায়াতের মৃতপ্রায় শিকড়ে পানি ঢালার চেষ্টা করছেন সেই কৌশল কাজে আসবে না। জামায়াতের কারসাজি আর অপকৌশল সম্পর্কে ভালোমতো অবগত রয়েছে দেশবাসী। বরং ব্যারিস্টার রাজ্জাক পদত্যাগ করে জামায়াতকে আরো সন্দেহের দৃষ্টিতে ফেলছেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এমন আচরণে জামায়াতের রাজনীতি আরো ষড়যন্ত্রময় হয়ে উঠছে। বর্তমান সরকারের সুশাসনে নিশ্চিন্তে বসবাস করা মানুষরা জামায়াতের কৌশলে কিছুটা ইতস্তত বোধ করছেন বলে আমি মনে করি।
বিষয়টিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, জামায়াতের রাজনৈতিক চাল বোঝা বড় দায়ের ব্যাপার। যে দল কোন দিন নিজেদের কুকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি, তাদের কাছে ব্যারিস্টার রাজ্জাক আবার দেশপ্রেম খোঁজার চেষ্টা করছেন। রাজ্জাকের আকুতি যেন পাষাণের কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়ার মতো। রাজ্জাক সম্ভবত জামায়াতের রাজনীতিতে খেই হারিয়ে ফেলায় হতাশা থেকে পদত্যাগ করেছেন। জামায়াত পুনর্গঠন নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা শুনেছিলাম। সম্ভবত জামায়াতের নতুন ধারার রাজনীতিবিদদের কাছে মূল্যায়ন না পাওয়ায় দলত্যাগ করেছেন রাজ্জাক। জামায়াতের রাজনৈতিক সংবিধানে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের মতো উদার চিন্তার কোন সুযোগ নেই।
তিনি কিছুটা সময়ে নিয়ে আরো বলেন, জামায়াত ঝোপ বুঝে কোপ মারা রাজনৈতিক দল। দুর্বল নেতৃত্ব, দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ইমেজ সংকটে পড়েছে জামায়াত। অবস্থা একই থাকলে ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাতায় ন্যক্কারজনক অবস্থানে থাকবে জামায়াত। সেই ভয় থেকেই জামায়াতের নতুন ধারার নেতারা দলটির পুনর্গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমার ধারণা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের মতে অমিল হওয়ার কারণেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। ফলদায়ী বৃক্ষের ছায়া সহজেই কেউ এড়াতে চায় না। জামায়াত নেতার পদত্যাগের বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও অস্বস্তি সৃষ্টি করবে। জামায়াত নেতার পদত্যাগে খুব বেশি খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। এরা কান্নার অভিনয় ভালো জানে। জামায়াতের প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে দেশবাসীকে সচেতন থাকা উচিত।