• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিশুদের রমজান পালনে বাবা মার করণীয়

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৭ মে ২০২০  

শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার। যেকোনো দেশ ও জাতির অস্তিত্ব একটি আদর্শ শিশুর ওপর নির্ভর করে। শিশুরা আদর্শবান হলে দেশের কল্যাণ বয়ে আসে, তেমনি একটি দেশের অধঃপতনেও শিশুদের পদস্খলনই মুখ্য। এ জন্য একটি শিশুর আদর্শবান ও চরিত্রবান হওয়ার বিকল্প নেই।

ইসলামে একটি শিশুর আদর্শবান হওয়ার জন্য যাবতীয় পথনির্দেশনা রয়েছে। রোজা ও রমজানের প্রশিক্ষণও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যে সন্তানটি হবে আদব-আখলাক ও শিষ্টাচারে সবার সেরা। যে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ সাধন এবং মুক্তির কারণ হবে। এমন সন্তান সবারই কাম্য।

সেই আদর্শ সন্তানের কল্যাণ পেতে ইসলামের অনুসরণ অনুকরণ জরুরি। ইসলামি বিধানমতো শিশুটিকে লালন-পালন করতে পারলে এ সুফল লাভ করা সম্ভব। আর শিশুকে গড়ার বা প্রশিক্ষণ দেয়ার অন্যতম মাস হলো পবিত্র মাহে রমজান। এ মাসে অন্যান্য কাজ একটু কমিয়ে শিশুর জীবন গঠনে চোখ রাখলে বেশ ফায়দা পাওয়া যাবে। এটি একটি শিশুর অধিকার এবং একজন অভিভাবকের ঈমানি কর্তব্য। যেহেতু শিশুরা রমজান আসার আগেই রোজা উদ্যাপনের জন্য প্রহর গুনতে থাকে। পরিকল্পনা আঁটতে থাকে এবার কে কয়টি রোজা রাখবে। কোনো কোনো শিশু তো বয়সে স্বল্প হলেও সবকটি রোজা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। 
রমজানের চাঁদ দেখতে শিশুরাই বেশি আনন্দিত হয়। তারা তার পড়শি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে তারাবি ও রোজা রাখার নানা পরিকল্পনার কথা শেয়ার করে। মাগরিবের পর থেকেই টুপি পাঞ্জাবি পরে মসজিদমুখী হয়ে যায়। সেহরির সময়েও কোনো কোনো শিশুকে ডাকতে হয় না, বরং সেই তার মা-বাবা, ভাই বোনকে ডেকে তুলে দেয়। আবার কোনো শিশুকে একবার ডাক দিলেই লাফিয়ে ওঠে দ্রুত দাঁত ব্রাশ করে সবার আগে সেহরি খেতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই এ রমজানেই শিশুর চরিত্র ও মানসিকতা উন্নয়নে গাইড দিতে হবে। এতে শিশুর জীবন গঠনে অভূতপূর্ব সফলতার গ্যারান্টি রয়েছে।

আমরা শিশুদের যতটা মনোযোগী বা কল্পনাশক্তিসম্পন্ন বলে ধারণা করি, তারা তার চেয়েও ঢের ক্ষমতা রাখে। তাই আপনি কী বলছেন, তা থেকে তারা বেশি লক্ষ্য করে আপনি সেসব নিজে কতটা মানছেন– সেদিকে। ফলে রমজান মাসকে আপনি তাদের সামনে তুলে ধরতে পারেন নতুন ভাবে, নতুন রূপে, আমলের মাধ্যমে। শুধু উপদেশ দিয়ে নয়, শিশুকে দেখিয়ে দেখিয়ে রমজান পালনেই আপনার শিশুর মাঝে রমজানের চেতনা ছড়িয়ে পড়বে। আপনি তার সামনে প্রধানতম ‘রোল মডেল’। তাই তার প্রাথমিক ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে আপনার দেখানো উদাহরণগুলো থেকে, কথা শুনে নয়। শিশু আপনার সব কর্মকাণ্ড অনুসরণ করছে– এটা জানলে সে-ই শুধু নয়, আপনিও সঠিক আচরণ করবেন এবং এর মাধ্যমে উপকৃত হবেন। শিশুর মধ্যে ইতিবাচক আচরণ ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠার জন্য দরকার সঠিক যোগাযোগ, আনন্দময় পরিবেশ এবং সৃষ্টিশীলতা। ভয় দেখিয়ে, কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে শিশুকে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক সঠিক কাজ করিয়ে নেয়া যায় সত্য, কিন্তু শিশুর মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই রমজানের আমলগুলো বা ইবাদতগুলো কোনো চাপে রেখে নয়, বরং নিজেরা এগুলো করে তাদেরকে শিখাতে হবে। ইফতার, সেহরি ও সদকার বিষয়গুলো তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে।

ইসলামে শিশুদের রোজা পালনের বিষয়টি নানা হাদিসে উঠে এসেছে। এ সব হাদিসে সাহাবারা সন্তানদের নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে রোজা রাখতেন বলে জানান। রমজানে অভিভাবকদের প্রথম দায়িত্ব শিশুদের রোজা রাখায় উদ্বুদ্ধ করা। রুবাই বিনতে মুআওয়েয ইবনে আফরা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার সকালে মদিনার আশপাশে আনসারদের এলাকায় (এই ঘোষণা) পাঠালেন, যে ব্যক্তির রোজা অবস্থায় সকাল শুরু করেছে, সে যেন তার রোজা পালন সম্পন্ন করে। আর যে ব্যক্তি বে-রোজদার হিসেবে সকাল করেছে সে যেন বাকি দিনটুকু রোজা পালন করে। এরপর থেকে আমরা আশুরার দিন রোজা পালন করতাম এবং আমাদের ছোট শিশুদেরও রোজা রাখাতাম। আমরা (তাদের নিয়ে) মসজিদে যেতাম এবং তাদের জন্য উল দিয়ে খেলনা তৈরি করে রাখতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে সেই খেলনা দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত সান্তনা দিয়ে রাখতাম। (বুখারী, হাদিস নম্বর- ১৯৬০ ও মুসলিম, হাদিস নম্বর- ১১৩৬)।

হজরত ওমর (রা.) রমজান মাসে এক মদ্যপকে বলেছিলেন, তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোট শিশুরা পর্যন্ত রোজাদার! এরপর তাকে প্রহার করা শুরু করলেন। (হাদিসটি ইমাম বুখারী সনদবিহীন বাণী (মুআল্লাক) হিসেবে শিশুদের রোজা পরিচ্ছেদে সঙ্কলন করেছেন)।

যে বয়সে শিশু রোজা পালনে সক্ষমতা লাভ করে সে বয়স থেকে পিতা-মাতা তাকে প্রশিক্ষণমূলক রোজা রাখাবেন। এটি শিশুর শারীরিক গঠনের ওপর নির্ভর করে। আলেমরা কেউ কেউ এ সময়কে ১০ বছর বয়স থেকে নির্ধারণ করেছেন। শিশুদের রোজা পালনে অভ্যস্ত করে তোলার বেশকিছু পন্থা রয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে শিশুদের রমজানের রোজা পালনে অভ্যস্ত করে তোলা সম্ভব। নিম্নে তেমন কিছু পদ্ধতি আলোচনা করা হলো-

১. শিশুদের কাছে রোজার ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো তুলে ধরতে হবে। তাদের জানাতে হবে সিয়াম পালন জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। জান্নাতের একটি দরজার নাম হচ্ছে আর-রাইয়্যান। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররা প্রবেশ করবে।

২. রমজান আসার পূর্বেই কিছু রোজা রাখানোর মাধ্যমে সিয়াম পালনে তাদের অভ্যস্ত করে তোলা। যেমন- শাবান মাসে কয়েকটি রোজা রাখানো। যাতে তারা আকস্মিকভাবে রমজানের রোজার সম্মুখীন না হয়।

৩. প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশে রোজা পালন করানো। ক্রমান্বয়ে সেই সময়কে বাড়িয়ে দেয়া।

৪. একেবারে শেষ সময়ে সেহরি গ্রহণ করা। এতে করে তাদের জন্য দিনের বেলায় রোজা পালন সহজ হবে।

৫. প্রতিদিন বা প্রতিসপ্তাহে পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে তাদের রোজা পালনে উৎসাহিত করা।

৬. ইফতার ও সেহরির সময় পরিবারের সব সদস্যের সামনে তাদের প্রশংসা করা। যাতে তাদের মানসিক উন্নয়ন ঘটে।

৭. যার একাধিক শিশু রয়েছে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া শিশুটির প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা না হয়।

৮. তাদের মধ্যে যাদের ক্ষুধা লাগবে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে অথবা বৈধ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। এমন খেলনা যাতে পরিশ্রম করতে হয় না। যেভাবে সাহাবিরা তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করতেন। নিভরযোগ্য ইসলামি চ্যানেলগুলোতে শিশুদের উপযোগী কিছু অনুষ্ঠান রয়েছে এবং রক্ষণশীল কিছু কার্টুন সিরিজ রয়েছে। এগুলো দিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।

৯. ভালো হয় যদি বাবা তার ছেলেকে মসজিদে নিয়ে যান। বিশেষতঃ আসরের সময়। যাতে সে নামাজের জামাতে হাজির থাকতে পারে। বিভিন্ন দ্বীনি ক্লাসে অংশ নিতে পারে এবং মসজিদে অবস্থান করে কোরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহ তায়ালার জিকিরে রত থাকতে পারে।

১০. যেসব পরিবারের শিশুরা রোজা রাখে তাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য দিনে বা রাতের কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নেয়া। যাতে তারা সিয়াম পালন অব্যাহত রাখার প্রেরণা পায়।

১১. ইফতারের পর শরীয়ত অনুমোদিত ঘুরাফেরার সুযোগ দেয়া। অথবা তারা পছন্দ করে এমন খাবার, চকলেট, মিষ্টি, ফল-ফলাদি ও শরবত প্রস্তুত করা।

আমরা এ ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে বলছি যে, শিশুর যদি খুব বেশি কষ্ট হয় তবে রোজাটি পূর্ণ করতে তার ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত নয়। যাতে তার মাঝে ইবাদতের প্রতি অনীহা না আসে অথবা তার মাঝে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি না করে অথবা তার অসুস্থতা বৃদ্ধির কারণ না ঘটায়। কেননা ইসলামী শরিয়তে সে মুকাল্লাফ (ভারার্পিত) নয়। তাই এ ব্যাপারে খেয়াল রাখা উচিত এবং সিয়াম পালনে আদেশ করার ব্যাপারে কড়াকড়ি না করা উচিত।

তবে শিশুদের মাঝে যারা টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত তাদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুদের একটু ঘামেই তাদের সারফেস এরিয়ার তুলনায় বেশি হয়। তাই শিশুরা পানিস্বল্পতায় ভোগে সহজেই।  রোজায় এ ঘাম থেকেই শিশুরা পানি স্বল্পতায় ভুগতে পারে। এ জন্য ইফতারের পর থেকে বেশি পরিমাণে পানি, শরবত, স্যালাইন পান করতে হবে। শিশুদের খাবারে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। রোজায় বাইরের খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়। বাইরের খাবার খেলে সোনামণিরা ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয়, বদহজমসহ বিভিন্ন ধরনের পেটের পীড়ায় ভুগতে পারে। তেলজাতীয় খাবার বেশি খেলে শিশুদের পেটের সমস্যা হতে পারে। ভাজাপোড়া খাবার বেশি খেলে পেটব্যথা, বদহজম হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব তেল ও ভাজাপোড়া খাবার শিশুদের কম খেতে দিন। রোজাদার শিশুদের বাসায় বানানো খাবার খেতে দিন। ইফতারিতে শরবত, স্যালাইন, ফিরনি, খেজুর, কলা, শসা ও ফলমূল, দই-চিঁড়া খেতে দিন। ছোলা-মুড়ি কম খাওয়াই ভালো।

গরমে খাবার খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, সহজেই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। তাই বাসি খাবার সোনামণিদের দেবেন না। এ বাসি খাবার থেকে হতে পারে ডায়রিয়া, আমাশয় কিংবা টাইফয়েড। ফ্রিজে খাবার রাখলে তা গরম করে খেতে দিন। শিশুদের দুর্বলতা দূর করতে প্রচুর পানি পানের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার, শাক-সবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। একসঙ্গে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়া ভালো। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বেশি করে দিন। রোজা রেখে রোদে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি বা খেলাধুলা করা যাবে না। অনেক শিশু-কিশোর সেহরির সময় উঠতে না পারায় খাবার না খেয়েই রোজা রাখে। এতে রোজার শেষভাগে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। শিশুর সেহরিতে আঁশ জাতীয় খাবার যেমন, শাক-সবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। এ ধরনের খাবার হজমে সহায়ক। রোজা রেখে যদি শারীরিক সমস্যা বেশি দেখা দেয় অথবা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে শিশুদের রোজা না রাখাই উচিত। কোনো ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।