• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাকাতের নিসাব ও বন্টনের খাতসমূহ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১০ মে ২০২০  

নিসাব হচ্ছে অর্থ বা সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ, যে পরিমাণটির ওপর মালিকানার এক বছর পূর্ণ হলে ব্যক্তির ওপর উক্ত অর্থ বা সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত হিসেবে আদায় করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

নিসাবের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমতুল্য সম্পদ বা অর্থ। ওই পরিমাণ সম্পদ কারো নিকট পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকলে তার ওপরে জাকাত ফরজ হয়। জাকাত দিতে হয় চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২.৫%।

জাকাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধি। জাকাতের নির্ধারিত বিধান নাজিল হয় হিজরতের পরে। সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কিংবা সাদাকা অর্থে দান খয়রাত করতেন। কিন্তু সেসব দানের মধ্যে ছিল সওয়াব লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কত পরিমাণ দান করতে হবে তার নির্দিষ্ট কোনো হার ছিল না।

এর বহু পরে সূরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াত নাজিল হলে জাকাত আদায় ও খাতওয়ারি ব্যয় করার বিধান বলবত হয়। সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে জাকাত ব্যয় করার ৮টি খাত নির্ধারিত করে বিধান নাজিল করা হয়। এখানে লক্ষণীয় এতে জাকাতকে সাদাকাত বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, 

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘সাদাকা (জাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সব জানেন, প্রজ্ঞাময়। (সূরা : আত তওবা : আয়াত ৬০)।

জাকাত সালাতের মতোই ফরজ এবাদত। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর আমলে ভণ্ড নবীদের একটা গ্রুপ জহাকাত না দেয়ার পক্ষে প্রচারণা চালালে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবো।’(বুখারি শরিফ), (মুসলিম শরিফ)।

জাকাতের নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে সাত তোলা সোনা অর্থাৎ ৮৭.৪৫ গ্রাম সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অর্থাৎ ৫১২.১৫ রৌপ্য অথবা ওই পরিমাণ সোনা বা রৌপ্যের দামের অর্থ অথবা সম্পদ। খাতের বাইরে অন্য কোনো খাতে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না।

জাকাতের সম্পদ সঠিকভাবে বন্টন করার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই কারণে আল্লাহ তায়ালা নিজেই জাকাত ব্যয় বন্টনের খাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ খাতের বাইরে অন্য কোনো খাতে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। নিম্নে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত উল্লেখিত ৮টি খাতের বর্ণনা দেয়া হলো-

জাকাত বন্টনের নির্ধারিত ৮টি খাতের বিবরণ :

প্রথম খাত : ফকির- ফকির হলো সেই ব্যক্তি যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। যে ব্যক্তি রিক্তহস্ত, অভাব মেটানোর যোগ্য সম্পদ নেই, ভিক্ষুক হোক বা না হোক, এরাই ফকির। যেসব স্বল্প সামর্থ্যের দরিদ্র মুসলমান যথাসাধ্য চেষ্ট করা সত্ত্বেও বা দৈহিক অক্ষমতাহেতু প্রাত্যহিক ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে না, তারাই ফকির। কারো মতে যার কাছে একবেলা বা একদিনের খাবার আছে সে ফকীর।

দ্বিতীয় খাত : মিসকিন- মিসমিন সেই ব্যক্তি যার কিছুই নেই, যার কাছে একবেলা খাবারও নেই। যেসব লোকের অবস্থা এমন খারাপ যে, পরের নিকট সওয়াল করতে বাধ্য হয়, নিজের পেটের আহারও যারা যোগাতে পারে না, তারা মিকিন। মিসকিন হলো যার কিছুই নেই, সুতরাং যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ নেই, তাকে জাকাত দেয়া যাবে এবং সেও নিতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ফকির বা মিসকিন যাকেই জাকাত দেয়া হবে, সে যেন মুসলমান হয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়।

তৃতীয় খাত : আমেলীন-  ইসলামি সরকারের পক্ষে লোকদের কাছ থেকে জাকাত, উসর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টনের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। এদের পারিশ্রমিক জাকাতের খাত থেকেই আদায় করা যাবে। কোরআনে বর্ণিত আটটি খাতের মধ্যে এ একটি খাতই এমন, যেখানে সংগৃহীত জাকাতের অর্থ থেকেই পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এ খাতের বৈশিষ্ট্য হলো এতে ফকীর বা মিসকীন হওয়া শর্ত নয়। পক্ষান্তরে, অবশিষ্ট ৫টি খাতে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ দূরীকরণে জাকাত আদায় শর্ত।

চতুর্থ খাত : মুআলস্নাফাতুল কুলুব (চিত্ত জয় করার জন্য)- নতুন মুসলিম যার ঈমান এখনো পরিপক্ক হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অমুসলিম। যাদের চিত্ত (দ্বীন ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করে) আকর্ষণ ও উৎসাহিত করণ আবশ্যকীয় মনে করে জাকাত দান করা হয়, যাতে তাদের ঈমান পরিপক্ক হয়। এ খাতের আওতায় দুঃস্থ নওমুসলিম ব্যক্তিদের জাকাত প্রদানের ব্যাপারে ফকিহরা অভিমত প্রদান করেছেন।

পঞ্চম খাত : ক্রীতদাস/বন্দী মুক্তি- এ খাতে ক্রীতদাস-দাসী/বন্দী মুক্তির জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। অন্যায়ভাবে কোনো নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দী হলে তাকেও মুক্ত করার জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।

ষষ্ঠ খাত : ঋণগ্রস্থ- এ ধরনের ব্যক্তিকে তার ঋণ মুক্তির জন্য জাকাত দেয়ার শর্ত হচ্ছে- সেই ঋণগ্রস্থের কাছে ঋণ পরিশোধ পরিমাণ সম্পদ না থাকা। আবার কোনো ইমাম এ শর্তারোপও করেছেন যে, সে ঋণ যেন কোনো অবৈধ কাজের জন্য- যেমন মদ কিংবা নাজায়েয প্রথা অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য ব্যয় না করে।

সপ্তম খাত : আল্লাহর পথে- সম্বলহীন মুজাহিদের যুদ্ধাস্ত্র/সরঞ্জাম উপকরণ সংগ্রহ এবং নিঃস্ব ও অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থীকে এ খাত থেকে জাকাত প্রদান করা যাবে। এ ছাড়াও ইসলামের মাহাত্ম ও গৌরব প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে যারা জীবিকা অর্জনের অবসর পান না এবং যে আলেমরা দ্বীনি শিক্ষাদানের কাজে ব্যাপৃত থাকায় জীবিকা অর্জনের অবসর পান না। তারা অসচ্ছল হলে সর্বসম্মতভাবে তাদেরকেও জাকাত দেয়া যাবে।

অষ্টম খাত : অসহায় মুসাফির- যে সমস্ত মুসাফির অর্থ কষ্টে নিপতিত তাদেরকে মৌলিক প্রয়োজন পুরণ হওয়ার মতো এবং বাড়ী ফিরে আসতে পারে এমন পরিমাণ অর্থ জাকাত থেকে প্রদান করা যায়।

এক নজরে জাকাত আদায় না করার পরিণতি :

(১) জাকাত না দেয়া প্রতিটি সম্পদের একটি আকৃতি হবে। যা আগুনে উত্তপ্ত করে ব্যক্তির শরীরে দাগিয়ে দেয়া হবে।

(২) কোনো কোনো সম্পদ বিষাক্ত সাপে পরিণত হবে এবং জাকাত আদায়কারীকে দংশন করতে থাকবে।

(৩) প্রাণী জাতীয় সম্পদসমূহ কোনটা শিং দিয়ে আঘাত করবে আবার কোনটা দাঁত দিয়ে কামড় দেবে।

জাকাত আদায়ের বিবিধ উপকারিতা ও শিক্ষা :

(১) গরীবের প্রযোজন পূর্ণ হয়।

(২) অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটন হয়।

(৩) সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতাকে শেষ করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়।

(৪) মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

(৫) দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

(৬) চুরি-ডাকাতি-চিনতাইসহ সবরকম অভাবজনিত অপরাধ মূলোৎটাটিত হয়।

(৭) গরীব-ধনীর মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয়।

(৮) সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, জাকাতের সম্পদ কমে না। (সহিহ মুসলিম- হা : ৬৭৫৭, মা :, শা :, হা: ৬৯/২৫৮৮, জামি আত তিরমিযী-হা : ২০২৯, সহিহ)।

অথাৎ- হয়তো দৃশ্যত: সম্পদের পরিমাণ কমবে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই স্বল্প সম্পদের মাঝেই বেশি সম্পদের কার্যকারী ক্ষমতা দিয়ে দেবেন।

(৯) সম্পদের পরিধি বৃদ্ধি পায়। কেননা সম্পদ যখন জাকাতের মাধ্যমে অভাবীদের মাঝে বন্টিত হয়, তখন এর উপকারিতার পরিধি বিস্তত হয়। আর যখন তা ধনীর পকেটে কুক্ষিগত থাকে, তখন এর উপকারিতার পরিধিও সংকীর্ণ হয়।

(১০) জাকাত প্রদানকারী দান ও দয়ার গুণে গুণান্বিত হয়।

(১১) অন্তরে অভাবীর প্রতি মায়া-মমতা সৃষ্টি হয়।

(১২) কৃপণতার ন্যায় অসৎ গুণ থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায়। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا

‘তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করো; যেন তুমি সেগুলোকে এর মাধ্যমে পবিত্র ও বরকতময়  করতে পার।’ (সূরা : আত তাওবাহ, আয়াত : ১০৩)।

জাকাত যাদের দেয়া যাবে না :

(১) উলামায়ে ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা দ্বারা পরিচালিত মাদরাসা অর্থাৎ যারা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য কুফরি মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই সমস্ত মাদরাসাতে জাকাত প্রদান করলে জাকাত আদায় হবে না।

(২) নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী বা ধনী ব্যক্তিকে জাকাত দেয়া যাবে না।

(৩) মুতাক্বাদ্দিমীন অর্থাৎ পূর্ববর্তী আলেমদেরর মতে কুরাঈশ গোত্রের বনু হাশিম-এর অন্তর্গত হজরত আব্বাস, হজরত জাফর, হজরত আকীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের বংশধরের জন্য জাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। তবে মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পরবর্তী আলিমদের মতে বৈধ।

(৪) অমুসলিম ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়া যাবে না।

(৫) যে সমস্ত মাদরাসায় ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোডিং আছে সেখানে জাকাত দেয়া যাবে এবং যে সমস্ত মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং নেই সেখানে জাকাত দেয়া যাবে না।

(৬) দরিদ্র পিতা-মাতাকে, সন্তানকে, স্বামী বা স্ত্রীকে জাকাত দেয়া যাবে না।

(৭) প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইয়াতীমখানা লিল্লাহ বোডিংয়ের জন্য জাকাত আদায়কারী নিযুক্ত হলে তাকে জাকাত দেয়া যাবে না।

(৮) উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামাজ-রোজা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায় তাকে জাকাত দেওয়া যাবে না। তবে সে যদি উপার্জন না থাকার কারণে জাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে জাকাত দেয়া যাবে।

(৯) বেতন বা ভাতা হিসেবে নিজ কর্মচারী, কর্মচারিণী বা কাজের পুরুষ ও নারীদেরকে জাকাতের টাকা দেয়া যাবে না।

পরিশেষে বলবো, জাকাত বর্তমানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আয়কর নয় বা গরিবের প্রতি দয়ার দানের বিষয় নয়। এটি ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। যা আল্লাহ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। জাকাত ব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে সমাজে দারিদ্র্য থাকবে না। সম্পদের জাকাত আদায় করা ফরজ।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সামর্থবান ব্যক্তিদের যথাসময়ে জাকাত প্রদান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।