• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

যে কারণে রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশক গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৯ মে ২০২০  

রহমত, বরকত, নাজাত। এ মাসের প্রতিটি দশকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ উপহার রোজাদারদের জন্য রেখে দিয়েছেন। রহমত বরকত শেষ হয়ে ২১ রমজানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নাজাতের বিশেষ দশদিন।

নাজাতের অর্থই হচ্ছে পরিত্রাণ কিংবা মুক্তি। যেহেতু সিয়াম সাধনা তথা এবাদত বন্দেগির মাধ্যমে বান্দা গুনাহ থেকে মুক্তি পান, পরকালে কঠিন শাস্তি তথা দোজখ থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন, এজন্যই মাহে রমজানকে নাজাতের মাস বলা হয়েছে। মাহে রমজানের যত ফজিলত রয়েছে তার শেষ কথাই হচ্ছে নাজাত। এই একমাসে ইফতার, সেহরি, সিয়াম সাধনা, নামাজ দোয়া, এবাদত বন্দেগি, দান সদকা ও ভালো কাজের সফলতাই হচ্ছে মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি তথা এই নাজাত।

রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা সময়টি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এ মাসের শেষ দশক বা শেষ দশ দিনকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন রাসূল (সা.)। তিনি এ সময় ইতিকাফসহ বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। মাহে রমজানকে মহানবী (সা.) নিজেই রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম ভাগে আল্লাহর রহমত, মধ্যভাগে গুনাহের মাগফেরাত এবং শেষ ভাগে দোজখের আগুন থেকে মুক্তিলাভ রয়েছে।’ (মিশকাত)। 

একটি হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসূল (সা.) অন্য সময়ের তুলনায় রমজানের শেষ দশ দিনে আমল-ইবাদতে অধিক পরিশ্রম করতেন (মুসলিম)। অপর বর্ণনায় হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রমজানের শেষ দশ দিনে প্রবেশ করে রাসূল (সা.) রাত জাগরণ করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন এবং পূর্ণভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন (মুসলিম)। ‘রমজানের শেষ দশ দিনে রাসূল (সা.) রাত জাগরণ করতেন’ হাদিসের এ অংশ দ্বারা প্রমাণিত হয় বা বোঝা যায়, প্রথম বিশ দিনে রাসূল (সা.) পূর্ণ রাত জাগরণ করতেন না; বরং রাতের কিছু সময় ইবাদত করতেন এবং কিছু সময় ঘুমিয়ে কাটাতেন। শেষ দশ দিনে এমনকি তিনি বিছানায়ও গমন করতেন না। রাতের পুরোটা সময় ইবাদতে কাটাতেন। 

একটি হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশকে এত বেশি চেষ্টা-সাধনা করতেন, যা অন্য মাসে করতেন না (মুসলিম)। আরো বর্ণিত আছে, শেষ দশক চলে এলে রাসূল (সা.) কোমর বেঁধে লাগতেন। নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন। পরিবারের লোকদের জাগাতেন (বুখারি ও মুসলিম)। উম্মুল মুমেনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন নবী করিম (সা.) তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি এবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন (সহিহ বুখারি)। এ ছাড়া হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত রয়েছে প্রথম বিশ দিনে রাসূল (সা.) ঘুম ও ইবাদতে কাটাতেন। শেষ দশ দিনে পূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। (মুসনাদে আহমদ)। 

যে কারণে রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশক গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন:

রমজানের শেষ দশকটি যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর রয়েছে। আর এটি এমন একটি রাত, যাকে হাজার মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। রমজানের শেষ দশকের কোন রাতটি ‘লাইলাতুল কদর’ তা নির্দিষ্ট নয়। এজন্য শেষ দশক জুড়ে মুমিন বান্দারা এ রাতের খোঁজে থাকেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের শেষ দশকে বা শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা লাইলাতুল কদর তালাশ করো। (বুখারি ও মুসলিম)। 

হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাতটিতে আমল-ইবাদতে কাটানোর মাধ্যমে পারলৌকিক সফলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত রমজানের শেষ দশককে গুরুত্ব দেয়া। হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ রাত ইবাদতে কাটানো বিরাট বড় একটি সুযোগ। এ ছাড়া রমজানের শেষ দশকে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত রয়েছে, আর তা হলো ইতিকাফ। পাপমোচন ও পুণ্য বৃদ্ধির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হলো ইতিকাফ। রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশকে আমৃত্যু ইতিকাফ করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)। 

সুতরাং পবিত্র রমজান মাসের বিদায়লগ্ন শেষ দশকে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত বেশি থেকে বেশি আমল-ইবাদতে সময় কাটানোর মাধ্যমে জীবনের কৃত পাপ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির চেষ্টা চালানো এবং পারলৌকিক সফলতা অর্জনের পথকে সহজ করার প্রার্থনায় মনোযোগী হওয়া।  

অতএব, মাহে রমজানের এই নাজাতের দিনগুলোতে এবাদত বন্দেগি করে, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে নিজের মুক্তি অর্জন করতে না পারলে সে প্রকৃত অর্থেই সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা মুসলমান। কারণ, সে জীবনে এই মাহে রমজান আর নাও পেতে পারে, এটিই তার শেষ রমজান হতে পারে। তাই প্রত্যেক বান্দার উচিত এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানো। 

এক হাদিসে রয়েছে, হজরত জিবরাইল (আ.) এসে নবীজী (সা.)-কে বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পাওয়ার পরও নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না। তখন নবীজী (সা.) বললেন, আমিন। (মুসতাদরাকে হাকেম)। তাই বান্দার উচিত পবিত্র রমজানের শেষ দশদিনে আগের যত গাফিলতি, ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে তা দূর করে একাগ্রচিত্তে সিয়াম সাধনা করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন করার মধ্য দিয়ে নাজাত প্রাপ্ত হওয়া। কোনভাবেই যেন আমরা মাহে রমজানের মতো আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামতকে হেলায় শেষ করে না দেই। আল্লাহ তায়ালা এ মাসের প্রতি রাত্রে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বেশি বেশি নেক আমল এবং তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদের এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভুক্ত করা। 

এ প্রসঙ্গে অন্য হাদিসে হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে। (সুনানে ইবনে  মাজাহ, হাদিস-১৬৪৩, মুসনাদে আহমদ, হাদিস-২২২০২, তবারানী হাদিস-৮০৮৮. বায়হাকী ৩৬০৫)। 

ঈদুল ফিতরের আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। সাধরণত রমজানের শেষ দশকে মুসলমানরা সদকাতুল ফিতর আদায় করে থাকেন। সাদাকাতুল ফিতর নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সব মুসলিমের জন্য ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব। দ্বিতীয় হিজরিতে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করার নির্দেশ দেন। একে সাধারণত রোজার ‘ফিতরা’ বলা হয়। এটা মূলত মাহে রমজানেরই নির্ধারিত সাদকা বা দান। বহু হাদিস দ্বারা সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি যে উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম (রোজা, তারাবি ও অন্যান্য আমল) পালন করে-তার প্রথম পুরস্কার এই যে, সে রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস-৮৯৬৬)।