• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলামের আলোকে স্বপ্ন ও এর ব্যাখ্যা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৬ জুন ২০২০  

হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটেছে। মুবাশ্শিরাত ছাড়া নবুওয়াতের আর কোনো অংশ বাকি নেই। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মুবাশ্শিরাত কি জিনিস? (মুবাশ্শিরাত অর্থ: সুসংবাদ দানকারী জিনিস)। উত্তরে রাসূল (সা.) বলেন, সত্য স্বপ্ন। (সহিহ বুখারি, মুসনাদে আহমদ, মুওয়াত্তা মালেক)।

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুবাশ্শিরাত হয় এবং এটি নবুওয়াতের একটি অংশ। অন্য এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ)।

স্বপ্ন ও কাশফ দ্বারা শরীয়তের হুকুম বদলাতে পারে না:

গুনাহর দায়ভার আমার ওপর বর্তাবে এমন কথা বলা মোটেই সহজ না। যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য এবং দ্বীনের সংরক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন, আল্লাহর এ ধরনের বান্দারাই এতটা আস্থা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এ জাতীয় কথা বলতে পারেন। যদি একবার এই নীতি সাব্যস্ত হয় যে, স্বপ্নের দ্বারাও শরীয়তের মাসয়ালা বদলানো যায় তাহলে শরীয়তের আর কোনো গুরুত্বই থাকে না। একেকজন একেক স্বপ্ন দেখত আর এসে বর্ণনা করে দিত। ব্যস, শরীয়তের মাসয়ালা পাল্টে যেত।

আজকাল যত জাহেল পীর আছে, তারা বিভিন্ন রকম বেদাতে লিপ্ত। তারা স্বপ্নকেই সবকিছু মনে করে। কোনো স্বপ্ন দেখল কিংবা কোনো কাশফ্ বা ইলহাম হলো আর এর ভিত্তিতেই শরীয়তের খেলাফ আমল শুরু করে দিল। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। যদি কারো কাশফ্ হয়; কাশফ্ জাগ্রত অবস্থায় হয় এবং তাতে আওয়াজ আসে এবং সে আওয়াজ কানে শোনা যায় কিন্তু এরপরও শরীয়তে কাশফ্ হুজ্জত না। কোনো ব্যক্তি যত বড় আলেম কিংবা বুজুর্গ হোক, তিনি যদি কোনো স্বপ্ন দেখেন কিংবা তার কোনো কাশফ্ হয় বা ইলহাম হয়, তা শরীয়তের বিধি-বিধানের বিপরীতে হুজ্জত না।

শায়েখ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) এর একটি ঘটনা:

আউলিয়াকুল শিরমণী হজরত শায়েখ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) একবার রাতে ইবাদতে মশগুল ছিলেন। তাহাজ্জুদের সময় ছিল। হঠাৎ একটি আলোর ঝলক দেখা গেল। আলোর ভেতর থেকে আওয়াজ আসে যে, হে আবদুল কাদের! তুমি আমার ইবাদতের হক আদায় করেছ, তুমি এমন স্তরে পৌঁছে গেছ যে, আজকের পর আমার পক্ষ থেকে তোমার ওপর কোনো ইবাদত ফরজ ও ওয়াজিব না। তোমার নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত আমি মাফ করে দিয়েছি। এখন থেকে তুমি যেভাবে ইচ্ছা আমল কর। আমি তোমাকে জান্নাতি সাব্যস্ত করছি। হজরত শায়েখ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) এ আওয়াজ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরে বলেন, মরদুদ, বিতাড়িত হ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তো নামাজ মাফ হয়নি। তাঁর সাহাবিদের থেকেও মাফ হয়নি। আমার থেকে কীভাবে মাফ হবে? দূর হ। তিনি বুঝতে পারেন এটি ছিল শয়তানের একটি কৌশল। এরপর আরেকটি আলোর ঝলক দেখা গেল। এটি পূর্বের আলোর ঝলক অপেক্ষা আরো বড় ছিল। তা থেকে আওয়াজ আসে, আবদুল কাদের, তোমার ইলম আজ তোমাকে বাঁচিয়ে দিল। তা না হলে এটা এমন এক কৌশল, যা দ্বারা আমি অনেক বড় বড় লোককে ধ্বংস করে দিয়েছি। যদি তোমার কাছে ইলম না থাকত তাহলে তুমিও ধ্বংস হয়ে যেতে। হজরত শায়েখ জিলানি (রহ.) বলেন, মরদুদ, আবার ধোঁকা দিচ্ছিস। আমার ইলম আমাকে বাঁচায়নি। আমার আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন।

আরেফিন বা তত্তবাদীরা বলেন, দ্বিতীয় কৌশলটি প্রথমটি অপেক্ষা আরো মারাত্মক ছিল। কারণ দ্বিতীয়টি দ্বারা তার মাঝে ইলমের গর্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছিল যে, তোমার ইলম ও তাকওয়া তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি তাও প্রতিহত করেন।

স্বপ্নের মাধ্যমে হাদিস প্রত্যাখ্যান করা বৈধ না:

ভাই, রাস্তা বড় বিপজ্জনক। শরীয়তের দাবি কি তা না দেখেই আজকাল অনেক লোক স্বপ্ন, কাশফ্, কারামত ও ইলহামের পেছনে পড়ে আছে। অনেক শিক্ষিত ও দ্বীনদার লোক দাবি করছে যে, অমুক হাদিস সহিহ না। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের অমুক হাদিস ইহুদিদের বানানো। জাল হাদিস। আমি এ বিষয়টি কাশফ্ এর মাধ্যমে অবগত হয়েছি। যদি এভাবে কাশফ্ হতে থাকে তা হলে দ্বীনের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা ওলামাদের প্রতি রহমত করুন, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দ্বীনের সংরক্ষক বানিয়েছেন। তারা দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী। কেউ দ্বীনের ওপর যাতে হামলা করতে না পারে এবং দ্বীনকে বিকৃত করতে না পারে তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দ্বীনের পাহারাদার বানিয়েছেন। মানুষ তাদের ওপর যত অভিসম্পাত করুক, তাদের যত নিন্দা করুক, তারা আল্লাহর নির্বাচিত পুত-চরিত্র জামাত। ওলামারা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, স্বপ্ন, কাশফ্, কারামত, ইলহাম এসবের কোনোটিই শরীয়তের দলিল ও হুজ্জত না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জাগ্রত অবস্থায় যা বর্ণিত হয়েছে তা শরীয়তে হুজ্জত। তাই কখনো কারো স্বপ্ন, কাশফ্, কেরামত ও ইলহামের দ্বারা প্রতারিত হয়ো না। হজরত থানবি (রহ.) বলেন, পাগল ও কাফেরদেরও কাশফ্ হয়। তাই কখনো এই ধোঁকায় পড় না যে, আলোর ঝলক দেখেছি বা মনে কিছু অনুভব হচ্ছে ইত্যাদি। কারণ শরীয়তে এগুলো মর্যাদার মাপকাঠি না।

স্বপ্নদ্রষ্টার কর্তব্য:

হজরত আবু কাতাদা (রাদি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় আর খারাপ স্বপ্ন হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। তাই কোনো ব্যক্তি যদি স্বপ্নে এমন কিছু দেখে, যা ভয়ের বা অপছন্দের, তাহলে বাঁ দিকে তিনবার থুতু নিক্ষেপ করবে এবং আউযুবিলাহি মিনাশ্শাইতানির রাজীম পড়বে। আর যে পার্শ্বে কাত হয়ে শুয়ে ছিল তা বদলে নেবে। ফলে স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, ইনশাআলাহ! (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজাহ)।

অনেক সময় মানুষ স্বপ্নে ভয়ের জিনিস দেখে অথবা খারাপ কোনো দৃশ্য দেখে। এরূপ স্বপ্ন দেখার পর যখনি জাগ্রত হবে সঙ্গে সঙ্গে উপরে বর্ণিত আমল করবে। যদি কোনো ব্যক্তি ভালো স্বপ্ন দেখে উদাহরণত নিজের কোনো দ্বীনি বা দুনিয়াবি উন্নতি দেখে সেক্ষেত্রে স্বপ্নের কথা একমাত্র তার কাছেই বলবে যে জানে যে, স্বপ্নের কথা শুনেই কোনো ব্যাখ্যা দিতে নেই। কারণ কিছু কিছু স্বপ্ন থাকে যেগুলো ব্যাখ্যা অনুযায়ী বাস্তবে ফলে থাকে। এ ছাড়া অন্য কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলা হয় আর সে শুনেই উল্টাপাল্টা কোনো ব্যাখ্যা দেয় তাহলে স্বপ্ন ভালো হওয়া সত্তেও ব্যাখ্যা অনুযায়ী তার ফল প্রকাশ পাবে।

স্বপ্ন বর্ণনাকারীর জন্য দোয়া করা:

যদি কেউ বলে, আমি স্বপ্ন দেখেছি। নিজের স্বপ্নের কথা বর্ণনা করে। এমন অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের আমল হলো, তিনি স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য এই দোয়া করতেন,

خَيْرًا تَلَقَّاهُ، وَشَرًّا تَوَقَّاهُ، وَخَيْرًا لَنَا وَشَرًّا عَلَى أَعْدَائِنَا

অর্থ: ‘আল্লাহ তায়ালা এ স্বপ্নের ভালো দিকগুলো তোমাকে দান করুন এবং তার অনিষ্ট থেকে তোমাকে হেফাজত করুন। আল্লাহ করুন, এ স্বপ্ন যেন আমাদের জন্য মঙ্গলময় হয় এবং আমাদের শত্রুদের জন্য অকল্যাণকর হয়।’

এ দোয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব বিষয় জমা করে দিয়েছেন। আপনাদের কাছেও যখন কোনো ব্যক্তি স্বপ্নের কথা বলবে আপনারাও তার জন্য এই দোয়া করবেন। যদি আপনার দোয়া স্মরণ না থাকে তাহলে নিজের ভাষায় দোয়া করবেন। স্বপ্নের তাৎপর্য, গুরুত্ব এবং আদব সম্পর্কিত উপরিউক্ত কথাগুলো অবশ্যই মনে রাখবেন। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন এবং দ্বীনের ওপর শুদ্ধভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।