• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সূরা আর-রুম; আয়াত ১-৮

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮  

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের এই পর্বে সূরা আর- রুমের ১ থেকে ৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ১ থেকে ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

الم (1) غُلِبَتِ الرُّومُ (2) فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ (3) فِي بِضْعِ سِنِينَ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْ بَعْدُ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ (4) بِنَصْرِ اللَّهِ يَنْصُرُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ (5)

“আলিফ, লাম, মীম।” (৩০:১)

“রোমকগণ (ইরানিদের কাছে) পরাজিত হয়েছে।” (৩০:২)

“(আরবের) নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু ওরা ওদের এই পরাজয়ের পর শিগগিরই বিজয়ী হবে।” (৩০:৩)

“(আগামী) কয়েক বছরের মধ্যেই। পূর্ব ও পরের সব সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে।” (৩০:৪)

“আল্লাহর সাহায্যে; তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি মহাপরাক্রান্ত, দয়াময়।” (৩০:৫)

ইতিহাসে এসেছে, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে ছিল। বিশ্বনবী (সা.) যখন মক্কায় বসবাস করছিলেন তখন আরব ভূখণ্ডের কাছে এক যুদ্ধে ইরানি বাহিনীর কাছে রোমের বাহিনী পরাজিত হয়। মহান আল্লাহ বিশ্বনবীকে জানিয়ে দেন, অচিরেই পরবর্তী যুদ্ধে রোমের বাহিনী জয়লাভ করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়ার পর মক্কার নওমুসলিমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন যে, মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধেও তাদের জয়লাভের ব্যাপারে আল্লাহর আশ্বাস বাস্তবায়িত হবে। কারণ, বিশ্বজগতের সবকিছু মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন, সম্মান দান করেন এবং নিজের রহমতের বারিধারায় অবগাহন করান।

এই পাঁচ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত অদৃশ্যের খবর এবং ভবিষ্যদ্বাণী এই মহাগ্রন্থের অন্যতম অলৌকিক নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়।

২. যেকোনো পরাজয়ে ভেঙে পড়লে চলবে না। সব সময় মহান আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার আশা রাখতে হবে।

৩. মহান আল্লাহ নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে সব কাজ করেন। ঈমানদার ব্যক্তিদের জয় এবং পরাজয় দু’টিই আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়। অবশ্য মুমিন ব্যক্তিদেরকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু এই চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফলাফল তাদের হাতে নেই বরং তা নিয়ন্ত্রণ করেন মহান আল্লাহ।

সূরা রুমের ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَعْدَ اللَّهِ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ وَعْدَهُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ (6) يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآَخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ (7)

“এটি আল্লাহরই অঙ্গীকার; আল্লাহ স্বীয় অঙ্গীকারের অন্যথা করেন না। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না।” (৩০:৬)

” তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক (অর্থাৎ যা কেবল চোখে দেখা যায় সে) সম্পর্কে অবগত, ওরা পরকালের (জীবন) সম্পর্কে অমনোযোগী।” (৩০:৭)

আগের কয়েকটি আয়াতে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুমিনদের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মহান আল্লাহ। আর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করো না কারণ, তাঁর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত সত্য এবং এর বাস্তবায়নে কোনোরকম হেরফের হবে না।

অবশ্য আল্লাহ তায়ালার প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই কিংবা যাদের বিশ্বাস দুর্বল তারা সৃষ্টিকর্তার প্রতিশ্রুতির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারে না। কারণ, আল্লাহর প্রজ্ঞা, ক্ষমতা ও কৌশল সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। তারা শুধু বাহ্যিক ঘটনাগুলো অবলোকন করে এর ভিত্তিতে জয়-পরাজয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। পরকালীন জীবন সম্পর্কে তারা অজ্ঞ বলে সবকিছুকে পার্থব জীবনের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে চায়। এর ফলে সৃষ্টিজগতের রহস্য উপলব্ধি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. মানুষ অনেক সময় নানা কারণে নিজের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু কোনো সীমাবদ্ধতার গণ্ডি না থাকায় মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবেই এবং তা অবধারিত।

২. পার্থিব দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি অনুরাগ মানুষকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন করে ফেলে। এ কারণে পরকাল সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

সূরা রুমের ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ لَكَافِرُونَ (8)

“ওরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না যে, আল্লাহ যথাযথভাবে এক নির্দিষ্টকালের জন্য আসমান, জমিন এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন? এবং নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের প্রতিপালকের (সঙ্গে) সাক্ষাতে অবিশ্বাসী।” (৩০:৮)

পবিত্র কুরআনের আরো অনেক আয়াতের মতো এই আয়াতেও মানুষকে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে তার বিচারবুদ্ধি ও বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে বলছেন: এই আসমান ও জমিন কে সৃষ্টি করেছেন? যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই এগুলো বানিয়েছেন? এই বিশ্বজগতের কি কোনো শুরু এবং শেষ নেই? জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যখন অনর্থক কোনো কাজ করে না তখন এই বিশাল সৃষ্টিজগত কি কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সৃষ্টি করা সম্ভব? এটা কি বিশ্বাস করা যায় যে, এই পৃথিবীতে আমরা যেসব কাজ করি সেজন্য কোনোদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহীতা করা লাগবে না?

অবশ্য যারা প্রবৃত্তি পূজারি এসব প্রশ্ন তাদের অন্তরে কোনো দাগ কাটে না। তারা ইন্দ্রিয় সুখ লাভ করার জন্য এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে রাজি নয়। যেকোনো মূল্যে ভোগবিলাসে মত্ত থাকাই তাদের কাজ। কিন্তু জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা মনে করেন, এই সৃষ্টিজগত একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে এবং আমাদেরকে একদিন কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:

১. ইসলাম মানুষকে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে যাতে সে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে।

২. এই বিশ্বজগত নির্ধারিত সময়ের জন্য এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে।

৩. কেয়ামত অস্বীকারকারীদের কোনো যুক্তি নেই। পার্থিব দুনিয়ার প্রতি লোভলালসা তাদেরকে পরকাল সম্পর্কে অন্ধ ও অজ্ঞ করে দেয়।