• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

কে সেরা, সাকিব না রফিক?

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০১৮  

২০০ টেস্ট উইকেট শিকারের মাহেন্দ্রক্ষণে প্রশংসার সাগরে ভাসছেন সাকিব আল হাসান। দেশ ছাপিয়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সারা ক্রিকেট বিশ্ব। সবার মুখে একটাই কথা, বাংলাদেশের বোলিং দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কথা বলে যারা গলাবাজি করেন, তাদের জন্য সাকিবের ২০০ টেস্ট উইকেট এক ‘কড়া জবাব’।

একজন স্পিনাররের ৫৪ টেস্টে ১৮ বার পাঁচ বা তার বেশি উইকেট সংগ্রহে ২০০ উইকেট ক্লাবের সদস্য হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অনেক বড় কৃতিত্ব। বিশাল অর্জন। তবে সাকিব আল হাসানের এমন সাফল্যের দিনে অনেকের মনেই ভেসে উঠছে আরও একটি মুখ, মুখে উচ্চারিত হচ্ছে আরও একটি নাম ‘মোহাম্মদ রফিক।

সাকিবের চেয়ে ২১ ম্যাচ কম মানে ৩৩ টেস্ট খেলে ১০০ উইকেট শিকারি বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। টেস্টে যে বোলার ৫ বার তার বেশি উইকেট শিকার করেছেন সাতবার। বোলিং ইকোনমি সাকিবের (৩.০১) চেয়েও ভাল (২.৭৯)। কেউ কেউ বলছেন, ইস! আরও বেশি টেস্ট খেলতে পারলে হয়ত মোহাম্মদ রফিকও সাফল্যের এমন ফলক স্পর্শ করতে পারতেন।

সন্দেহ নেই রফিকও অনেক বড় বোলার। স্পিনার হিসেবে তাকেও এতটুকু খাট করে দেখার সুযোগ নেই। সাকিবের আগে বাংলাদেশের সেরা স্পিনার হিসেবে রফিককেই ভাবা হতো।

jagonews

যদিও টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পরও ভাবা হতো রফিক মূলতঃ সীমিত ওভারের বোলার। সেই ভাবনায় শুরুর দিকে রফিকের চেয়ে টেস্টে এনামুল হক মনিকে ভালো অপশন ভাবা হয়েছে। মনিকে বেশ কিছু টেস্ট খেলানোও হয়েছে। না হয় রফিক নিশ্চিতভাবেই অন্তত গোটা দশেক টেস্ট বেশি খেলতে পারতেন।

আজ সাকিবের ২০০ টেস্ট উইকেট শিকারের দিনে তাই অনেকের মুখেই একটি কৌতুহলি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক নম্বর বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনার কে? সাকিব আল হাসান, নাকি মোহাম্মদ রফিক? নাকি অন্য কেউ? কিংবা এ দুজনের মধ্যে কে সেরা, রফিক না সাকিব?

সেই ৭০-এর দশকের একদম শেষ ভাগ থেকে দেশের ক্রিকেটে একঝাঁক মেধাবি ও দক্ষ বাঁ-হাতি স্পিনারের পদচারনা। গত তিন যুগেরও বেশি সময়ে উঁচুমানের দক্ষ বাঁ-হাতি অর্থোডক্স স্পিনারদের তালিকায় আছে অনেক নাম- রামচাঁদ গোয়ালা, আতিক (মূলতঃ ভারতীয়, তবে আশির দশকের প্রায় পুরো সময় বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে এদেশেরই হয়ে গেছেন), এনামুল হক মনি, মোহাম্মদ রফিক, এনামুল জুনিয়র, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান, আরাফাত সানি, মাঞ্জারুল রানা, ইলিয়াস সানি, মোশাররফ রুবেল, তাইজুল প্রমুখ।

সাফল্যের মানদন্ডে বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নজর কাড়া ও ম্যাচ জেতানো নৈপুণ্যকে মানদন্ড ধরলে সন্দেহাতীতভাবেই সাকিব সবার ওপরে। সাকিবের সাফল্য বলে শেষ করা কঠিন। টেস্ট-টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে সর্বাধিক উইকেট শিকারী। আর ওয়ানডেতে অধিনায়ক মাশরাফির ঠিক পরে দ্বিতীয় সর্বাধিক উইকেট শিকারীও তিনি।

দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র বোলার, স্পিনার যার নামের পাশে ২০০ টেস্ট উইকেট, শুধু এই কারণে সাকিব এক নম্বর? তাহলে বাকিরা কে কোথায়? বিশেষ করে মোহাম্মদ রফিকের অবস্থান কোথায়? জাগো নিউজের সাথে আলাপে এসব কৌতুহলি প্রশ্নর উত্তর দিয়েছেন দেশের ক্রিকেটের তিন নামি ব্যক্তিত্ব মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, হাবিবুল বাশার ও মোহাম্মদ সালাউদ্দীন।

এই তিন জনের মধ্যে সালাউদ্দীন মনে করেন, সবচেয়ে সফলতম বোলারই বলেই শুধু নয়, সাকিবই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার। অন্যদিকে জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু এবং হাবিবুল বাশার মনে করেন, দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক ও ধরনের বোলার। তাই তুলনা করা ঠিক হবে না। তবে দুজনই একমত, রফিক হচ্ছেন সহজাত প্রতিভা। যার লাইন ও লেন্থ ছিল নিখুঁত। অ্যাকিউরিসি অনেক বেশি। ক্রমাগত একই জায়গায় বল ফেরতে পারতেন।

কিন্তু সাকিবের উইকেট শিকারের সামরর্থ্য বেশি। ব্যাটসম্যানকে বোঝার ক্ষমতা এবং ব্যাটসম্যানের প্লাস-মাইনাস ঠাউরে বল করায় সাকিব অনন্য। বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের দূর্বলতা দেখে, জেনে ও বুঝে বল করায় সাকিবের জুড়ি নেই। তাই রফিকের চেয়ে সাকিবই বেশি কার্যকর।

তবে মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, হাবিবুল বাশার সুমন ও সালাউদ্দীন তিনজন এক জায়গায় একমত- মেধা, দক্ষতা ও হাতের কাজ তো আছেই, এর বাইরে সাকিবের ক্রিকেট বোধ-বুদ্ধি অনেক বেশি। তা কাজে লাগিয়েই সাফল্যের মানদন্ডে সাকিব সবার ওপরে।

আজকের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ও টেস্টে ২০০ উইকেট শিকারী বাঁ-হাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান তার ছাত্র। বিকেএসপি থেকেই মাগুরার কিশোর সাকিবকে চেনেন ও জানেন সালাউদ্দীন।

তার হাত ধরেই ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে পা রাখা সাকিবের। পরবর্তীতে যিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের রীতিমত মেন্টর বনে গেছেন। সেই গুরু মোহাম্মদ সালাউদ্দীন মনে করেন, বোলার মানে স্পিনার সাকিবের চেয়ে ক্রিকেটার সাকিব অনেক বেশি কুশলী, দক্ষ। যার ক্রিকেট বোধ, বুদ্ধি বেশি। চিন্তার গভীরতাও প্রচুর। মূলতঃ এই বাড়তি গুণগুলোই সাকিবকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিয়েছে।

জাগো নিউজের সাথে আলাপে বাঁ-হাতি স্পিনার সাকিবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সালাউদ্দীন বলে ওঠেন, ‘আসলে সাকিবের ক্রিকেট বুদ্ধি-জ্ঞান ও অনুভব ক্ষমতা অনেক বেশি। যেহেতু নিজে ব্যাটসম্যান, তাই ব্যাটসম্যানের চিন্তা, চেতনা, মতি-গতি খুব ভাল বোঝে। ব্যাটসম্যান কখন কি চিন্তা করতে পারে, কোন সময় তার বিপক্ষে কি স্ট্র্যাটেজি নিতে পারে- এসব সাকিব খুব ভাল বোঝে ও আগেভাগে অনুমান করতে পারে।

আর সে কারণেই স্পিনার সাকিব অনেক বেশি কৌশলী। দুরদর্শি ও বুদ্ধিমান। তার বোলিংয়ের বিপক্ষে ব্যাটসম্যান কখন কোন কৌশল অবলম্বন করবে, তা আগেভাগে টের পাবার কারণে নিজের সম্ভাব্য বোলিং কৌশলটাও ঠিক ঠাউরে ফেলতে পারে। তাতেই সাফল্যের দেখা মেলে।

এ ছাড়া ব্যাটসম্যানের দুর্বলতাও খুব দ্রুত বোঝার ক্ষমতা আছে তার। ব্যাটসম্যান কখন ডাউন দ্য উইকেটে যাবে, সেটা কি অফ সাইড কভার করে, না অন সাইডে সরে- এসব খুব দ্রুত ধরতে পারে সাকিব। তাই অনেক সময় উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে একটু টেনে দেয়, আবার কখনো ওয়াইড ডেলিভারি ছুড়ে ব্যাটসম্যানকে বোকা বানায়।’

শুধু বুদ্ধি, কৌশল ও দুরদর্শিতা থাকলেই তো আর এক নম্বর হওয়া যায় না! বলেও কারুকাজ থাকা চাই। একজন স্পিনার হিসেবে টার্ন আর বৈচিত্রও প্রয়োজন। সেটা কতটা আছে সাকিবের? গুরু সালাউদ্দীনের ধারণা, সেটাও আছে পুরোপুরি। সালাউদ্দীনের অনুভব, সাকিবের বোলিং বৈচিত্র্য অনেক বেশি। যা ছিল না কারোরই।

তাই তো সালাউদ্দীনের মুখে এমন কথা, আমরা বাঁ-হাতি বিশ্বমানের বোলারের কথা উঠলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে দুটি মুখ। দুটি নাম- মোহাম্মদ রফিক আর সাকিব আল হাসান। দু’জনই অনেক বড় বোলার।

রফিক ভাইও অসাধারণ প্রতিভাবান। এক জায়গায় বল করার ক্ষমতা ছিল অস্বাভাবিক। অনেকটা সময় একই স্পটে বল করতে পারতেন। খুব জোরের ওপর সোজা (আর্ম বল) ডেলিভারি ছুঁড়তে পারতেন। লাইন-লেন্থ আর সোজা বলের ওপর অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে রফিক ভাইকে স্বচ্ছন্দে খেলা, তাকে হাত খুলে মারা ছিল বেশ কঠিন। সে কারণে রফিক ভাইয়ের সাফল্যও যথেষ্ঠ।

তবে আমার মনে হয় সাকিবের বোলিং ভ্যারাইটি তুলনামূলকভাবে রফিক ভাইয়ের চেয়ে বেশি। ব্যাটসম্যানকে রিড করে, তার মনের অবস্থা বুঝে এবং দুর্বলতা চিহ্নিত করে বল করার অসাধারণ ক্ষমতা আছে সাকিবের।

মনের জোর প্রচন্ড। কিছুতেই ভড়কে যায় না। কখনো ব্যাটসম্যান তার ওপর চড়াও হলেও বুদ্ধির জোরে আবার কামব্যাক করতে জানে। এছাড়া বোলিং বৈচিত্র্যও বেশি। এক জায়গায় ক্রমাগত একই ধরনের ডেলিভারি না করে ফ্লাইটে ভেরিয়েশন আনার পাশাপাশি সোজা ডেলিভারি এবং টার্নে ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করার সামর্থ্যটা ভালই আছে সাকিবের। তাইতো একদম সাদামাটা বোলিং অ্যাকশন নিয়েও টেস্টের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও সফল সাকিব।

sakib

ভাগ্য বিড়ম্বনা ও সে সময়ের বোর্ড কর্তাদের বৈরি আচরণের শিকার হয়ে টেস্ট খেলা হয়নি। তাই নামের পাশে সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারের স্টিকার নেই। তারপরও ধরা হয়, বেশিরভাগ স্থানীয় ক্রিকেট বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞের ধারনা, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুই ছিলেন সবচেয়ে দক্ষ ও কুশলী ব্যাটসম্যান।

বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বর্তমান প্রধান নির্বাচক সেই নান্নু মনে করেন, সাকিব ও রফিক সম্পুর্ণ ভিন্ন ঘরানার স্পিনার। তার মূল্যায়ন, সাকিব উইকেট টেকিং বোলার। যে কোন সময় ব্রেক থ্রু উপহার বা উইকেট এনে দিতে পারে। সাকিবের উইকেট শিকারের ক্ষমতা সবার চেয়ে বেশি।’

কেন তার বলে কি টার্ন বেশি? ফ্লাইট বৈচিত্র্য আর স্টক ডেলিভারিও বেশি? নান্নুর জবাব, ‘আসলে সাকিব ব্যাটসম্যানকে খুব ভাল বুঝতে পারে। ব্যাটসম্যান কখন কি করতে পারে, তার চিন্তা-ভাবনা কি? এসব খুব দ্রুত বুঝে নিতে পারে। আর সে অনুযায়ী বল করার ক্ষমতাও আছে। তাই সাফল্য বেশি। অন্যদিকে রফিক একদমই ন্যাচারাল স্পিনার। সহজাত প্রতিভা। এক জায়গায় অবিরাম বল ফেলতে পারতো।

টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরু থেকে যিনি মোহাম্মদ রফিককে স্পিনার হিসেবে পেয়েছেন, আবার ক্যারিয়ার সায়াহ্নে সাকিব ছিলেন যার বোলিং অস্ত্র- সেই হাবিবুল বাশারের মূল্যায়ন- রফিক আর সাকিবের মধ্যে কে সেরা, তা নির্নয় করা কঠিন। কারণ দুজনার বোলিং স্টাইল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাকিব একটু ফ্লাইট দেয়। আর রফিক ছিল আরও বেশি অ্যাকিউরেট। একদম জায়গামত বল করতে পারতো।

তবে সাকিবের অনুভব ও উপলব্ধি ক্ষমতা বেশি। ব্যাটসম্যানের গতি-প্রকৃতি খব জলদি বুঝে উঠতে পারে। ব্যাটসম্যান কি করতে পারে, তার বিপক্ষে কেমন অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন হবে? তা বুঝে নেয় চট জলদি। তা বুঝে ত্বরিৎ জায়গামত সঠিক অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষতা বেশি। তাই সাকিবের কার্যকরিতাও বেশি।