• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

অলৌকিক জায়নামাজ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১ জানুয়ারি ২০২১  

‘জেভিয়ার দীর্ঘ ও ময়লা দড়ির মত, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বিস্তৃত শুধুমাত্র একটি জীবন যাপন করে না। জীবনকে সে যাপন করে না, ঘুমায়। এই জীবন-ঘুমে সে স্বপ্ন হতে স্বপ্নে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুমের ভেতরেই অন্য স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের ভেতরে আবার ঘুম...।

ফলে তার ঘুম হল একটি বাক্সের মত, যেটার ভেতরে অন্য একটা বাক্স বসানো থাকে, সেই বাক্সের ভেতরে থাকে আরেকটা বাক্স, এবং সেটার ভেতরে আরেকটা। এভাবেই চলতে থাকে।

যেমন এই মুহূর্তে সে ঘুমাচ্ছে চার্লস ব্রিজের পার্শ্ববর্তী এক বাসায় ও একইসাথে পর্বতের উপরের কাঠের তৈরি অন্য এক বাসায়। এবং, তার দুটো ঘুমই অর্গানের দুটো দীর্ঘ একঘেয়েমি সুরের মত পরস্পরের প্রতিধ্বনি করছে। এবং এই দুই সুরের সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটি সুর।’ – মিলান কুণ্ডেরা (Life is Elsewhere)

ছোটবেলা থেকেই এন্ডারসনের রূপকথা, আরব্য রজনীর কল্পকথা, এডগার এলান পো’র রহস্য গল্প তথা মৃত্যু ভিত্তিক ভয়ার্ত ম্যাকাবার (macabre) ধরণের গল্প আমিনুলের ভীষণ পছন্দ। কতবার সে এন্ডারসনের রূপকথার সেই ধীবর পুত্রের মতো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেয়ে কল্পনায় গভীর সমুদ্রের তলদেশে চলেছে। সেখানে সাগরতলের রাজ্যের  রাজকন্যার সাথে ‘চির বসন্তের দ্বীপ’-এ বসবাস। শীতহীন ও সময়হীন কত শত বসন্ত উদযাপন। এক সময়ে স্বপ্নের ভেতরেই সে শুনতে পেয়েছে উপেক্ষার অতীত মায়ের অদৃশ্য ডাক। অতঃপর রাজকন্যার ভালবাসাকে উপেক্ষা করে প্রত্যাবর্তন করেছে সমুদ্র তীরের বেলাভূমিতে। বাস্তব পৃথিবীতে। এই কাহিনীকে বাস্তবের ভেতরে প্রতিস্থাপন করার জন্যে সমুদ্রে যাবার প্রয়োজন হয় না আমিনুলের। খরকা বিলের বিস্তীর্ণ জলজ প্রান্তর আর পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া হাটখোলা বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত বালুময় রাস্তাই তার জন্যে যথেষ্ট সমুদ্র তথা বেলাভূমিকে কল্পনার ভেতরে জাগিয়ে তুলতে। 

কোন কোন সময়ে ‘আরব্য রজনী’র ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ এর গল্প তাকে সারাক্ষণ স্বপ্নময়তার মধ্যে নিবিষ্ট রাখে। মর্জিনার বুদ্ধি দীপ্ততায় সে প্রবলভাবে মুগ্ধ। প্রশংসা না করে পারে না। এই ধরণের একটা মেয়ে কেন রাজকন্যা না হয়ে দাসী হিসেবে জীবন যাপন করছিল, এর পক্ষে সে কখনই সে যুক্তি খুঁজে পায় না। মর্জিনাকে সে ‘দস্যু বাহরামের’ সঙ্গিনী রণ রঙ্গিণী সুফিয়া হিসেবেই কল্পনা করতে অধিকতর স্বচ্ছন্দ বোধ করে। নিজ বাড়িতে অবস্থান করেও সে নিজেকে প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে শেহেরজাদের কল্পনার পৃথিবীতে। ঘরের কোণে আলমারির ভেতরে রাখা বইগুলোর সবগুলোই সে পড়ে ফেলেছে,যদিও সে প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডী এখনো অতিক্রম করেনি।  

 

 

আমিনুলের বাবা-মার ঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে বাঁশের টঙের ওপরে বিশাল মাচা। দিনের আলোর কিয়দংশও এই মাচার ভেতরে পৌঁছায় না। কারণ সামনের দিকে শুকনো পাটের গাঁট পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে দুর্ভেদ্য দেয়ালের সৃষ্টি করেছে। এর অব্যবহিত পিছনেই মাচার ওপরে বিশাল একটা ধানের গোলা এবং অনেকগুলো মাটির বড় বড় জালা। বিশাল জালাগুলোতে তার মা ধানের মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ধান ও চাল ভর্তি করে রাখেন। বছরের প্রায় ছয়মাস সময়কাল এরা খালি থাকে। খালি জালাগুলোর ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমিনুলের ধারণা চল্লিশ চোরের অন্তত দু’একজন হলেও তাদের বাড়ির মাচার ভেতরে লুকিয়ে আছে! সে প্রায়ই ধানের জালাগুলোর মুখ খুলে দেখে। ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা! অপসৃয়মান গুটি কয়েক ইঁদুরের প্রাণান্তকর দৌড় ছাড়া কোন তস্করই তার দৃষ্টিতে পড়ে না। তবুও আমিনুল প্রতিনিয়ত প্রবেশ করে রহস্যে ভরা এই অন্ধ কুঠুরি সম মাচার ভেতরে। নিজের মন গড়া কোন রহস্যের রাজ্যে!

ইতিহাস বিষয়ে আমিনুলের আগ্রহ প্রবল। তার বাবার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ‘চাহার দরবেশ’ বই পড়া থেকে এর সূত্রপাত। পরবর্তীতে সে রুমির মসনবি বইটার বাংলা অনুবাদ পড়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম প্রচার করতে আসা হজরত শাহজালাল এবং তার সাথে আসা অনেক দরবেশের কাহিনীই তার আত্মস্থ। বিগতরাতে খরকা বিলের জলের ওপর দিয়ে চাঁদের আলোয় তাদের বাড়ির দিকে অবয়ব হীন মুখের একজন মানুষের হেঁটে অথবা ভেসে আসা তাকে খুবই চমৎকৃত করেছে। হজরত শাহজালাল সঙ্গীসহ জায়নামাজে করে নদীর ওপরে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিলেন। ভাবতেই ‘আরব্য রজনী’র দৃশ্যপট তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যাদুকরী কার্পেটে করে সে উড়তে উড়তে খরকা বিল ছাড়িয়ে শ্রীহট্ট পেরিয়ে ‘মায়ার দেশ’ আসাম পেরিয়ে কামরূপ-কামাখ্যায় পৌঁছে যায়। সেখানে কোন রাজা নেই, কিন্তু আছে রানী!    

আমিনুল পড়েছে যে, হজরত শাহজালালের পূর্বপুরুষগণ কোরায়েশ বংশের অর্থাৎ নবীজির বংশের ছিলেন। হিজরি ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে তারা মক্কা শহর ত্যাগ করে ইয়েমেনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানে ৬৭১ হিজরিতে অর্থাৎ ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল জন্ম গ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার পিতামাতা দুজনেই পরলোকগমন করেন। তখন তাকে পালক হিসেবে গ্রহণ করেন তার মামা দরবেশ আহমেদ কবির। তিনি তার ধর্মগুরু ছিলেন। তিনিই তাকে পুনরায় মক্কায় নিয়ে যান। শাহ জালালকে সূফী মতেও তিনিই তাকে দীক্ষিত করে তোলেন। এখানেই তিনি ভারতবর্ষে গিয়ে ইসলাম প্রচারের স্বপ্ন দেখেন। শোনা যায়, যাত্রাকালে কবির শাহ জালালের হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বলেন, “যে স্থানে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ মিলে যাবে সেখানেই তুমি ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে”।

শাহজালাল ২৪০ জন শিষ্য নিয়ে দিল্লীতে আগমন করলেন। এখানে নিজামুদ্দিন আওলিয়া তাকে সুরমা রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার দিলেন। আমিনুলদের বাড়িতেও কয়েক জোড়া জালালি কবুতর আছে। আমিনুল নিজ হাতে তাদের জন্যে কাঠ এবং বাঁশ দিয়ে অন্দর বাড়ির দেয়ালের সাথে বাসা তৈরি করে দিয়েছে। এই কবুতরদের সাথে আমিনুলের দারুণ সখ্য। সকালের দিকে  এরা ঝাঁক বেঁধে উত্তরের দিকে চলে যায়। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আমিনুল প্রায়ই মনে মনে ভাবে, “আমিও যদি এদের সাথে উড়ে যেতে পারতাম!”  দিগন্ত ছাড়িয়ে শাহজালালের পুণ্যভূমি শ্রীহট্টে! দরবেশ চাচা সম্পর্কে আমিনুলের পূর্ণ ধারণা নেই। বাবার কাছ থেকে তার হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু শুনলেও, ঐটুকু তথ্য নিয়ে সে খুশী নয়। সে আরো জানতে চায়। কিন্তু জন্মলগ্ন হতেই তার ষড়যন্ত্র ঠিকভাবে গঠিত না হবার ফলে সে সবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয় না। বিশেষ করে বিগত রাতে প্রত্যক্ষ করা জলের ওপর দিয়ে নৌকা ছাড়াই পরিভ্রমণের বিষয়টি তার কাছে বোধগম্য নয়। 

হজরত শাহজালাল তার ৩৬০ জন শিষ্য নিয়ে সিলেট বা শ্রীহট্ট অভিমুখে যাত্রা করলেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে শ্রীহট্ট লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। গৌড় রাজ্যের রাজা ছিলেন গোবিন্দ। তার রাজ্যের সীমা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমায় নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণা। শাহ জালাল তার সঙ্গীদের নিয়ে জায়নামাজের ওপরে চড়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত দিনারপুরে অবস্থান গ্রহণ করেন। গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সক্ষম হয় না। রাজা গোবিন্দ তখন উপায়ন্তর না দেখে তাদের সম্মুখবর্তী অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্যে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।কিন্তু শাহ জালাল এবং তার সহযাত্রীরা পূর্বের ন্যায় জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। অতঃপর বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহ পুর নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন। এ বিষয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ‘তোয়ারিখে জালালী’তে নিম্নরুপ উল্লেখ আছে:

‘চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন।
এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।
যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।’

আমিনুল পড়েছে যে, উত্তর পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নামের দুই  নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। এ নদীগুলোতে প্রবল স্রোত থাকে। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা সুরমা নদীকে ‘নহরি আজরফ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহজালাল ফতেপুর হতে যাত্রা করে সুরমা তীরে অবস্থান নিয়েছিলেন।  এ নদী পার হলেই গৌড়ের রাজধানী। রাজা গোবিন্দ তার আগমনের সংবাদ পেয়ে সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু  শাহ জালাল ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে অনায়াসে নদী অতিক্রম করেছিলেন, এবং তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলেন। জানা যায়, রাজা গোবিন্দ প্রবল ভয় পেয়ে প্রথমে গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্ত গিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। কিন্তু তারপর তার আর কোন হদিস মেলেনি কোনদিন।

দিন বা রাত বলে কিছু নেই। যতোক্ষণ আমিনুল জেগে থাকে, ততোক্ষণ তার মাথার ভেতরে কিছু না কিছু ঘুরপাক খেতে থাকে। গতকাল রাতের চন্দ্রালোকিত প্রহর; খরকা বিলের কেন্দ্রস্থলে অমাবস্যার চাঁদের মতো থালা; থালা বিভক্ত হয়ে দুটো গোলকের সৃষ্টি; সেখান হতে মানুষের অবয়ব ধারণ, নাকমুখহীন মুখমন্ডল; অতঃপর বাড়ির দিকে জলের উপর দিয়ে যাত্রা। এই সকলকিছুই তাকে বিশাল বিস্ময়ের ঘোরের ভেতরে ফেলে দেয়। তার সমস্ত বাস্তবতার বোধ কল্পনার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যকার পার্থক্য তার কাছে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। 

‘I shut my eyes and all the world drops dead;
I lift my lids and all is born again.
(I think I made you up inside my head.)’ - Sylvia Plath