• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর দৃষ্টিতে ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়া

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

মহররম আসলেই যে লোকটি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন তিনি হচ্ছেন মোয়াবিয়া (রা.) এর পুত্র ইয়াজিদ। এর সঙ্গে পিতা মুয়াবিয়ার আলোচনাও হয়।

ইয়াজিদের যেমন কিছু কুকীর্তি আছে, তেমনি দ্বীনের জন্য অবদানও আছে। কিন্তু কিছু কিছু লেখক ইয়াজিদকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করেছে। দেখানো হয়েছে সুন্দরী নারী না পাওয়ার ব্যর্থতা ও ক্ষমতা হারানোর আশংকা থেকে ইয়াজিদ প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে। যার সূত্র ধরে হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) এর নির্মম পরিণতি।

কোনো কোনো বিশ্লেষক ইয়াজিদ ও হুসাইন (রা.) এর মাঝে সংঘটিত ঘটনায় জাহেলি  যুগের বংশীয় বিদ্বেষের সূত্র খুঁজে পান। প্রখ্যাত সংস্কারক ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এটাকে চরমপন্থিদের বক্তব্য বলে মত দিয়েছেন। সামনে ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের বক্তব্য তুলে ধরব। পাঠকবৃন্দ তখন নিজেরাই ইয়াজিদ ও তার দ্বারা সংঘটিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়া নায়ক না ভিলেন তার ফয়সালা আমাদের করা নিষ্প্রয়োজন। কারণ এ ব্যাপারে আমাদের পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম ফয়সালা করে গেছেন। প্রখ্যাত সংস্কারক ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে। আমি মনে করি এর পর আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। তিনি লেখেন ‘উসমান (রা.) এর মর্মান্তিক শাহাদত ও একে কেন্দ্র করে উম্মতের মাঝে অনৈক্য ছড়িয়ে পড়া থেকেই মূলত ফেতনার সূচনা। এক দল তৈরি হলো, যারা  উসমানকে মহব্বত ও আলীকে গালিগালাজ করে। ওরা ছিল শামবাসী। আরেক গ্রুপ আলীকে খুব ভালবাসে, কিন্তু উসমানের প্রতি বিদ্বেষ রাখে। ওরা ছিল কূফার। এদের গোমরাহি বেড়ে এক পর্যায়ে তারা হজরত উমর ও আবু বকর (রা.)-কে গালমন্দ করতে লাগে।

আবু বকর ও উমর (রা.)-কে সবার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া, আলী ও উসমানকে ভালবাসা সুন্নতের  অন্তর্ভূক্ত। এর বিপরীত করা গোমরাহি। এই নীতির ওপর মুমিনের অটল অবিচল থাকা ও ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশ্মিকে আকড়ে থাকা চাই। কারণ এই নীতির ভিত্তি হচ্ছে ইলম, ইনসাফ, কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রাসূল।

রাফেজি গোমরা সম্প্রদায় সাহাবায়ে কেরামকে গালি দিতে শুরু করলে, উলামায়ে কেরাম ওদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। পরে ওরা সাহাবায়ে কেরামকে কাফের বলা শুরু করল। এবং সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে ওদের বানোয়াট কথার কোনো অন্ত রইল না। তখনো কেউ ইয়াজিদের বিষয়ে  আলোচনা তুলেনি। ইয়াজিদের সমালোচনাকে কেউ দ্বীনদারিও মনে করেনি। তারপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। ইতোমধ্যে বহু অঘটন ঘটে। এরপর শুরু হয় ইয়াজিদের বিষয়। কেউ কেউ ইয়াজিদকে লানত দিতে শুরু করে। ওদের উদ্দেশ্য ছিল এর দ্বারা অন্যদেরকে লানতের রাস্তা উন্মুক্ত করা। ইসলামের নীতি হচ্ছে কেউ কাফের না হলে সরাসরি তাকে লানত করা জায়েজ নেই। তাই উলামায়ে কেরাম বিষয়টিকে অপছন্দ করেন। এতে আবার ভুল বুঝা শুরু হয়। একদল মনে করতে লাগে, ইয়াজিদ অনেক বড় মুত্তাকি আল্লাহওয়ালা ছিল। অন্যথায় উলামায়ে কেরাম তার ওপর লানত করাকে অপছন্দ করবেন কেন?

এখান থেকে ইয়াজিদকে কেন্দ্র করে কট্টরপন্থি দুটি গ্রুপ তৈরি হলো। এক দলের বিশ্বাস ইয়াজিদ কাফের, জিন্দিক ইত্যাদি। সে রাসূল (সা.) এর দৌহিত্র হজরত হুসাইনকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে পুরনো ইতিহাস। ইয়াজিদের পূর্ব পুরুষ উতবা, ওয়ালিদকে হত্যার বদলায় সে রাসূল (সা.) এর নাতিকে এমন মর্মান্তিকভাবে শহীদ করেছে। তারা ইয়াজিদের আরো দোষ বের করল যে, সে প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ করে, মদ খায় ইত্যাদি।

এর বিপরীত আরেক গ্রুপ মনে করত ইয়াজিদ ন্যায়পরায়ন  শাসক। সে ছিল হক পথে। মানুষের দ্বীনদারি পালনে সে খুবই সহযোগিতা করত। সে সাহাবি ছিল। সাধারণ কোনো সাহাবি নয় বরং বড় মাপের সাহাবি। আর কেউ কেউ তো তাকে নবী  হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেনি। তারা ইয়াজিদের মর্যাদা বুঝানোর জন্য হাদিসের নামে মিথ্যা  বানোয়াট কথা ছড়াত। তারা বলত, যে ব্যক্তি ইয়াজিদের ব্যাপারে চুপ থাকবে সে জাহান্নামে যাবে না।’ এগুলো তারা বানাত। আর সূত্র হিসেবে উল্লেখ করত শায়েখ হাসান ইবনে আদির নাম।

হকপন্থি উলামায়ে কেরাম মনে করেন, এ দু’গ্রুপের অবস্থানই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অবস্থানের বিপরীত (আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত হচ্ছে ওই দল যারা রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুযায়ী নিজেদের জীবন চালিয়ে, আখেরাতে মুক্তিপ্রাপ্তদের কাতারে শামিল হবে)। কারণ, ইয়াজিদ সাহাবি ছিল না। তার জন্ম হজরত উসমান (রা.) এর খেলাফত কালে। দ্বীনদারিতেও সে উঁচু মাপের কোনো বুযূর্গ ব্যক্তি ছিল না। সে ছিল একজন মুসলিম নওজোয়ান। আবার সে কাফের বা জিন্দিকও ছিল না। পিতা মুআবিয়া (রা.) এর মৃত্যুর পর সে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে। সাহাবায়ে কেরামের মাঝে তখনো অনেকে জীবিত ছিলেন। তাদের মাঝে কেউ কেউ বিষয়টিকে অপছন্দ করেন। আবার পছন্দ করেছেন এমন সাহাবিও ছিলেন। সে ছিল একজন সাহসী ব্যক্তি। সম্ভ্রান্ত বংশীয়। প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ বা মদপান করা তার থেকে প্রমাণিত নয়; যেমনটি কেউ কেউ বলে থাকেন।

তার সময়ে মুসলিম বিশ্বে বড় দুটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এক ছিল হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদত। আসল বিষয় হচ্ছে ইয়াজিদ হজরত হুসাইন (রা.)-কে হত্যার নির্দেশ দেয়নি এবং তার মৃত্যুতে সে খুশিও হয়নি। হুসাইন (রা.) এর শির শামে বহন করে আনাও হয়নি। তবে সে হুসাইন (রা.)-কে প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছিল এবং এ জন্য যদি হত্যা করতে হয় তাও। তার অনুসারীরা তার নির্দেশে ডালপালা বের করে। শিমার, ইবনে যিয়াদকে উস্কানি দেয়। তখন ইবনে যিয়াদ সীমালংঘন করে হজরত হুসাইনকে হত্যা করে। শহীদ হওয়ার পূর্বে হজরত হুসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে চলো কিংবা কোনো সীমান্ত অঞ্চলে চলে যাওয়ার সুযোগ দাও বা মদিনায় ফিরে যেতে দাও। কিন্তু ওরা তাকে বন্দি করা ছাড়া কোনোটিতে রাজি ছিল না। অবশেষে আমর ইবনে সাদ হত্যার নির্দেশ দিলে, হজরত হুসাইন ও তার সঙ্গীরা মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন।

হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদত ছিল মুসলিম বিশ্বের সংকট। হজরত উসমান (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে যে ফেতনার সূচনা হয়েছিল, হজরত হুসাইন (রা.) এর হত্যার দ্বারা তা আরো ঘনিভূত হলো। এ দুজন মহান ব্যক্তিকে যারা হত্যা করেছিল, তারা হচ্ছে সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কারবালার ঘটনার পর হজরত হুসাইন (রা.) এর পরিবার ইয়াজিদের কাছে আসলে, সে তাদেরকে অনেক খাতির করে, সম্মান দেখায় এবং মদিনায় পাঠায়। বর্ণিত আছে, হজরত হুসাইনকে হত্যার কারণে ইবনে জিয়াদকে ইয়াজিদ লানত করে। এবং বলে, কূফাবাসীর আনুগত্য চেয়েছি, হুসাইনকে হত্যা করতে চাইনি। এতদ্বসত্তেও হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা বা কোনো প্রতিবাদ তার থেকে প্রকাশ পায়নি। তার পক্ষ্য থেকে হজরত হুসাইনকে সাহায্যের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া হত্যাকারীদের বিচার করা তার ওপর ওয়াজিব ছিল, কিন্তু সে তা করেনি। এ জন্য উলামায়ে কেরাম, তার অন্যান্য অন্যায় কাজের সঙ্গে এরও নিন্দা করেছেন। তবে তার বিরোধী কট্ররপন্থি গ্রুপ, তার ব্যাপারে অনেক মিথ্যা বানোয়াট কথাবার্তা ছড়িয়েছে।

ইয়াজিদের সময় দ্বিতীয় সংকট ছিল মদিনার সংলগ্ন র্হারা নামক স্থানের যুদ্ধ। কারণ, মদিনাবাসী তার বাইয়াত ভঙ্গ করে, নিযুক্ত গভর্র্নরকে বের করে দেয়। তখন ইয়াজিদ বাহিনী পাঠায় এবং নির্দেশ দেয়, তিন দিন অপেক্ষার পর যদি অনুগত না হয় তাহলে যুদ্ধ করবে। মদিনার হারামে তিন দিনের জন্য রক্তপাত বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। সৈন্য বাহিনী মদীনায় ডুকে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। এরপর আরেক বাহিনী মক্কায় পাঠায়। মক্কা অবরোধ কালে ইয়াজিদ মারা যায়। এই জুলুম ও অন্যায় হয়েছিল ইয়াজিদের নির্দেশে।

এ বিষয়গুলো সামনে রেখে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মত হচ্ছে আমরা ইয়াজিদকে গালিও দেব না এবং তার সম্পর্কে মহব্বতও রাখব না। সালেহ ইবনে আহমদ, তার পিতা আহমদ ইবনে হাম্বলকে বলেন, এক দল লোক ইয়াজিদকে মহব্বত করে। আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, কোনো মুমিন কি তাকে মহব্বত করতে পারে? তখন ছেলে বলে, তাহলে আপনি তাকে লানত করেন না কেন? আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, তুমি তোমার পিতাকে কখনো কাউকে লানত করতে দেখেছ?

মোটকথা হচ্ছে, উলামায়ে কেরামের নিকট ইয়াজিদ একজন বাদশাহ। উলামায়ে কেরাম তাকে বুযূর্গদের ন্যায় মহব্বতও করেন না আবার তাকে গালিও দেন না। এবং নির্দিষ্টভাবে কোনো মুসলমানের ওপর লানত করাকে আলেমগণ পছন্দ করেন না। সর্বশেষ কথা হচ্ছে, ইয়াজিদ ফাসেক, জালেম। আল্লাহ তায়ালা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। বিশেষ করে যখন তার নেকের পাল্লাও কোনো কোনো দিক থেকে ভারী। বুখারী  শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে, ‘যে বাহিনী ইস্তাম্বুলে প্রথম যুদ্ধাভিযান চালাবে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, ইস্তাম্বুলে প্রথম অভিযান ইয়াজিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। সেখানে আবু আইউব আনসারী (রা.) ছিলেন।’ (ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৫২)

শামসুদ্দিন জাহাবী, জীবন চরিত রচনার ক্ষেত্রে তাকে সবচেয়ে নিরপেক্ষ ভাবা হয়। তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘সিয়ারু আলামিল নুবালা’তে উল্লেখ করা হয়েছে, মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়াকে এক লোক ইয়াজিদের বিভিন্ন দোষের কথা জিজ্ঞেস করেন। এর মধ্যে মদপান ও প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজের কথাও ছিল। তিনি উত্তরে বলেন, এগুলো কোনটাই তার থেকে প্রমাণিত নয়।’ আল্লামা জাহাবীও ইস্তাম্বুলের যুদ্ধে তার অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। এবং এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, তার বিষয়টি বড় হওয়ার কারণ হচ্ছে, সে যে সময় রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয় তখন বড় বড়  অনেক সাহাবা জীবিত ছিলেন। (সিয়ারু আলামিল নুবালা, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১)  বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ইয়াজিদ, হুসাইন (রা.) এর শাহাদত সম্পর্কে জানত না।’ তাই ইয়াজিদকে ভিলেন বানানো বা লানত করা কোনোটি কাম্য নয়। বরং তার ব্যাপারে ওই বিশ্বাস পোষণ করব যা আমাদের পূর্ববর্তীরা করে গেছেন।