• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূলের ঘরে ঘরে ডিজিটাল ব্যাংক

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২১  

দুর্গম এক চর ঢালচর। বর্ষায় বলতে গেলে বাকি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। আবহাওয়া ভালো থাকলে দিনে দুয়েকবার যাতায়াতের সুযোগ আছে উপজেলা হাতিয়া বা মনপুরার সঙ্গে। এ চরে ১০ হাজার মানুষের বাস। এখানকার বাসিন্দাদের অনেকে কাজ করেন শহর ও অন্যান্য অঞ্চলে। অন্যসব যোগাযোগ অনুন্নত হলেও লোকগুলোর উপার্জিত অর্থ মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে তাদের ঘরে। আর এমনটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কারণে।

দিনে আয় সন্ধ্যায় বাজার

এই চরের মসজিদ মার্কেট এলাকায় বাস করেন মাইমুনা আক্তার। স্বামী গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রামে রিকশা চালান। তার দিনের উপার্জিত অর্থ সন্ধ্যায় চলে আসে মাইমুনার মোবাইলে। বিকাশ, নগদ, রকেট ও ড্যাচ বাংলাসহ সব সুবিধাই আছে এই পরিবারের। টাকা পাওয়ার পর তা তুলতে ও বাজার করতে সন্ধ্যায় বের হন মাইমুনা।

মাইমুনার মতো চরের বাকিসব পরিবারেরও আছে মোবাইল ওয়ালেট ও মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা। চরের বাজারে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং-এর দোকান। মুহূর্তেই নগদ টাকা উঠিয়ে নিতে পারেন তারা।

Digital coast Part 3 (6)মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা রয়েছে দোকানে দোকানেমাইমুনার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক সময় স্বামী দূরের কোনও জেলা শহরে কাজের সন্ধানে গেলে সুদে টাকা নিয়ে আমাদের দিয়ে যেতো। মাসের পর মাস সেই ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে হতো আমাদের। দিশেহারা হয়ে পড়তাম। এখন সুদের কারবারিরা সেধেও ঋণ দিতে পারে না। কারণ স্বামী দিনে যা আয় করে সন্ধ্যার মধ্যেই সেটা আমার মোবাইলে চলে আসে। মোবাইলই এখন আমাদের ব্যাংক।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢালচরের প্রতিটি মানুষের মোবাইল ফোনে ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে। উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরের দুর্গম এলাকাগুলোতেও মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজারগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর এজেন্ট আছে যথেষ্ট।

ডাচ বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং (রকেট ) কর্মকর্তা মো. এরশাদ হোসেন  জানান, ‘২০১১-১২ সালে সুবর্ণচরে মোট এক হাজার গ্রাহকও বানাতে পারিনি। ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা ফিরলে প্রচুর গ্রাহক হয়।’

এ কর্মকর্তার মতে সুবর্ণচরের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকই এখন মোবাইল ব্যাংকিং-এর আওতায় আছে। ডিজিটাল এ লেনদেন ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা।

 উপবৃত্তির টাকা কাটতে পারে না

সোনাদিয়া ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের পরিচালক মুজাম্মেল হোসেন মিলন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একসময় লেনদেনের জন্য কয়েক কিলোমিটার হেঁটে জেলা সদরে যেতে হতো। এতে সময় তো লাগতোই, নিরাপত্তার ঝুঁকিও ছিল। এখন মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং-এ লেনদেন করছে। প্রতিটি পরিবারে অন্তত একটি করে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট আছে। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকাও এর মাধ্যমে আসছে।’

নিঝুমদ্বীপের নামারবাজার স্কুলের শিক্ষার্থী ঝরনা আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আগে স্যারেরা বিভিন্ন খরচের কথা বলে আমাদের উপবৃত্তির টাকা কেটে রেখে দিতো। এখন পারে না। কারণ টাকা আমাদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে চলে আসে।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতি নিয়ে সরকারের দূরদর্শিতার কারণে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে মাইমুনাদের মতো উপকূলের প্রতিটি ঘরে। এর সুফল পাওয়া সম্ভব হয়েছে ডিজিটালাইজেশনের কারণেই।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে যখন দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয় তখনও এমনটা কেউ ভাবতে পারেনি। মোবাইল ফোনের টেকনিক্যাল ব্যবহার বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

Digital coast Part 3 (5)পরিসংখ্যান

দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখন এসব সেবার গ্রাহক। সারা দেশে এসব সেবায় নিবন্ধনের সংখ্যা ১৪ কোটি (একজনের একাধিক অ্যাকাউন্ট ধরে)। সক্রিয় ব্যবহারকারী আছে ৫ কোটির কিছু কম।

এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিএফডি) পরিচালিত অন্য এক জরিপে দেখা যায়, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাধ্যমে মাসে ১ হাজার ১১ কোটি টাকা যায় গ্রামে। ৬২ শতাংশ শ্রমিক নিয়মিত গ্রামে টাকা পাঠান। এদের ৮২ শতাংশই মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি বিকাশ-এর ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা গেছে, বিকাশ ব্যবহারে মানুষের আয় বাড়ছে।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল ব্যাংকিং-এর ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। বন্যার সময় ক্যাশ-ইন ৩৩ শতাংশ এবং ক্যাশ-আউট ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। এটি এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিঘাত মোকাবেলার সক্ষমতাকেই তুলে ধরে।

জানতে চাইলে বিকাশ-এর হেড অফ করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্গম এলাকার মানুষের অন্যতম ভরসা মোবাইল ব্যাংকিং। লেনদেন পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির মতো আমাদের বিকাশ-এর ক্যাশইন ও ক্যাশআউট সেবা শহর থেকে গ্রামমুখী। অর্থাৎ শহরে টাকা ক্যাশ ইন হয় বেশি এবং গ্রামে ক্যাশ আউট হয় বেশি।’