• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

গরুর গাড়ি এখন রূপকথার গল্প

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৯ মার্চ ২০১৯  

একসময় গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাহন ছিল গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা এখন রূপকথার গল্পমাত্র। এখন গরুরগাড়ি বিলুপ্ত হয়ে স্থান পেয়েছে সংবাদপত্র ও বইয়ের পাতায়।  

আবহমান গ্রামবাংলার জনপদে কৃষি ফসল বহন ও মানুষ বহনের বাহন ছিল দু-চাকার গরুর গাড়ি। আধুনিকতার যান্ত্রিক ছোঁয়ায় ও ডিজিটাল পদ্ধতির কাছে হার মেনে গ্রাম বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা বিলুপ্তপ্রায়। আর গরুর গাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ততায় হারিয়ে যেতে বসেছে গাড়িয়াল পেশা। গ্রামগঞ্জের আঁকা বাঁকা মেঠো পথে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি। 

দেশের গ্রামীণ জনপদের মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি বাহনের সরগরম অস্তিত্ব ছিল এবং ছিল সর্বত্র  এই গরুর গাড়ির কদর। গরুর গাড়ি নিয়ে কবি লেখকরা লিখেছেন তাদের কবিতার ভাষায় কত না কবিতা, শিল্পীরা গেয়েছেন কতই না ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে অন্যতম গান হল ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে.......।

বর্তমানে গ্রামগজ্ঞে ২/১টি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই চোখে পড়ে না।  আধুনিক সভ্যতায় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি হারিয়ে যেতে বসেছে। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। আবার অনেক শহরে শিশু গরুর গাড়ি দেখলে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে গরুর গাড়ি সম্পর্কে। যুগ যুগ ধরে কৃষকের কৃষি ফসল বপন ও বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল গরুর গাড়ি। 

গরু গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সঙ্গে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সঙ্গে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে।

দুই যুগ আগে গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে হতো না। বিয়ে বাড়ি বা মালামাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন বাহন। বরপক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্য ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাওনি (টাপর) সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করত। রাস্তাঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাত। বিয়ে এবং অন্য কোন উৎসবে গরুর গাড়ি ছাড়া পূর্ণতা পেতো না। হাতে গোনা দু’একটা গাড়ি দেখা যায় গ্রামের মেঠো পথে তাও জরাজীর্ণ অবস্থায়। তাছাড়া যেন চোঁখেই পড়ে না এই গরুর গাড়িগুলো। শহরের ছেলে মেয়েরাতো দূরে থাক গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ির এই বাহনের সঙ্গে পরিচিত না খুব একটা। আগে অনেকের এই গাড়ি গুলো ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন কিন্তু এখন গরুর গাড়ি চলে না। যে সব পরিবারে গরুগাড়ি ছিল, তাদের কদরের সীমা ছিল না। কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরুর গাড়িতে কখনো জৈব সার তথা গোবরের সার, কখনো গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোয়াল নিয়ে যেত মাঠে। 

বর্তমান যুগ হচ্ছে যান্ত্রিক যুগ। মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালগাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা ইত্যাদি। ফলে গ্রামাঞ্চলেও আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি। অথচ গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো, এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এটি পরিবেশবান্ধব একটি যানবাহন। রিকশা বা ঠেলাগাড়ির মতো গরুর গাড়িও একটি পরিবেশবান্ধব যান। এতে কোনো জ্বালানি খরচ নেই। শব্দ দূষণ নেই। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এসব কিছুই এই যানে ব্যবহার হয় না। এই গরুর গাড়ি ধীর গতিতে চলে বলে তেমন কোনো দুর্ঘটনাও নেই। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এই গরুরগাড়ি প্রচলন আজ হারিয়ে যাচ্ছে।

যশোরের চৌগাছার যাত্রাপুর গ্রামের কৃষক বুদো ও আব্দুল মাজিদ কথা প্রসঙ্গে বলেন, বাপ-দাদারা গরুর গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতো। কিন্তু এখন গরুর গাড়িতে আর কেউ চলতে চায়না। তাই অটো ভ্যান ও ইজিবাইক চালিয়ে গাড়িয়ালরা তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এখন গরুর গাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্যগুলোকে আমাদের মাঝে ধরে রাখতে আবারো গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশাকে টিকেয়ে রাখতে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।