• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

গাজীপুরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চলছে নানা অনিয়মে

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২০  

গাজীপুরে সরকারের নিবন্ধন নিয়ে প্রায় দুই ডজন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চলছে নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় প্রতিটির বিরুদ্ধে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানি না থাকাসহ নিবন্ধনের বেশিরভাগ শর্ত পূরণ না করার অভিযোগ রয়েছে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এই জেলায় নিবন্ধিত ২২টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকরা কেউই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সনদের সব শর্ত মানছেন না। শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা হচ্ছে; সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স নেই। তারপরও তারা মাদকাসক্তি নিরাময়ের চিকিৎসা দেওয়ার নামে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ভর্তি করে যাচ্ছেন।

এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রায় সবাই এক সময় মাদকাসক্ত ছিলেন। কেই কেউ মাদক মামলার আসামিও ছিলেন।

এদিকে, যেসব প্রতিষ্ঠান শর্ত মানছে না তাদের বিষয়ে তথ্যাদি ঢাকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে; সেখান থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সরকারি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও এলাকার ‘নিউ অঙ্গীকার মাদসাক্তি নিরাময় কেন্দ্রের’ সহকারী পরিচালক জাহিদুল হাসান সাকিব জানান, তিনি নিজেও মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে মাদকসহ ধরা পড়ার পর তিন দিন জেলও খেটেছেন তিনি।

তিনি আরও জানান, তার কেন্দ্রের পূনর্বাসন পরিচালক ইমরান হোসেন এবং সহকারী পরিচালক ফজলে রাব্বীও মাদকাসক্ত ছিলেন। তারা সবাই মাদকাসক্ত পূনর্বাসন কেন্দ্রে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর এই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।

চিকিৎসক সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের এই সেন্টারে রোগীদের দুইজন চিকিৎসক থাকলেও তারা সার্বক্ষণিক থাকেন না। এখানে একজন নার্স ও একজন ওয়ার্ড বয় আছেন।

গত অক্টোবরে এখানে ১৪ জন মাদকাসক্ত রোগী ভর্তি ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, রোগী প্রতি চিকিৎসা ও খাওয়া-দাওয়ার জন্য প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা নেন।


গাজীপুর মহানগরের হাজীবাগ এলাকার ‘আলোর জীবন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের’ সুমন ঘোষ জানান, ১০ জন স্টাফ নিয়ে কেন্দ্র চালাতে খুবই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সার্বক্ষণিক ডাক্তার-মনোচিকিৎসক ও নার্স তার কেন্দ্রে নেই।
চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “চিকিৎসকরা সপ্তাহে একদিন/দুইদিন আসেন। তারা যে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন আমরা তা রোগীদের সরবরাহ করি। তবে কোনো কোনো রোগী কথা না শুনলে কিংবা বেশি পাগলামী করলে চড়-থাপ্পর কিছু দিয়ে তাদের ঠিক রাখতে হয়।”

তিনি বলেন, লাইসেন্সের পুরোপুরি শর্ত পালন করা কোনো কেন্দ্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য মহানগরীর কোনাবাড়িতে তাদের ‘উইনার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র’ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই কেন্দ্র পরিচালনার লাইসেন্সের শর্ত শিথিল করা উচিত।  

এই কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে কাগজে দুইজন চিকিৎসক এবং ওয়ার্ড বয় দেখানো হলেও সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক নেই। অপর্যাপ্ত ক্লাসরুমেই রোগীদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। এখানে যারা কাউন্সেলিং করছেন তারাও এক সময় মাদকাসক্ত ছিলেন।

প্রায় একই কথা বললেন নগরীর গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে অবস্থিত ‘আদর্শজীবন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের’ চিফ প্রোগ্রামার জাহিদ হোসেন।

তিনিও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র তথা পূনর্বাসন কেন্দ্রগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের শর্তের শিথিলতা দাবি করেন।

তিনি নিজে মাদকাসক্ত হওয়ার পর তিন বছর আগে যে কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছিলেন সেখানেও সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক ছিলেন না বলে জানান।

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকায় তিন বছর আগে একটি আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে ‘মৌচাক মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূর্নবাসন কেন্দ্র’ গড়ে তুলেছেন ফখরুল ইসলাম মজুমদার নামে এক ব্যক্তি। তিনিও মাদক আসক্ত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনিসহ নয় স্টাফই ছিলেন মাদকাসক্ত যারা নিজেদের মাদকমুক্ত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদনে ১০ বেডে ১০ জন থাকার কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে ১০ বেড দেখিয়ে সেখানে ১৮ জন রোগী রেখেছে এই কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।

এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ফখরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, তার এখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকে না। সপ্তাহে দুয়েকদিন চিকিৎসক আনা হয়। এছাড়াও খুব প্রয়োজন হলে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বহুতল ভবন ভাড়া নেওয়ায় জায়গার সংকুলান তেমন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিত্তবিনোদনের অন্যতম ব্যবস্থা হিসেবে টিভি দেখার ব্যবস্থা রেখেছেন। তিন মাস চিকিৎসা দেওয়ার শর্তে এখানে রোগী প্রতি ৩৫/৪০ হাজার টাকা নেওয়া হয়।

“আমরা সরকারি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবে অর্থাভাবে তা পালন করা সম্ভব হয় না।”

গাজীপুর মহানগরের ‘ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের’ পরিচালক আরিফ মাহবুব রোমান বলেন, “আমি নিজেও এক সময় (২০০৩ সালে) মাদকাসক্ত ছিলাম। পরে নারয়ণগঞ্জের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। আমার জীবনের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমি মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিতে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি।”

২০১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পান জানিয়ে তিনি বলেন, পরিচালনার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লাইসেন্সের যে শর্ত রয়েছে তা পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব হয় না। তাই লাইসেন্সের শর্ত শিথিল করা দরকার।

প্রতি রোগীর জন্য চার মাসের প্যাকেজ খরচ ৬০ হাজার টাকা নেন; তবে গরীব রোগীর জন্য ছাড় দেওয়া হয় বলে তিনি জানান। 

এক রোগীর স্বজন গাজীপুরের বরমী গ্রামের ছালেহা আক্তার বলেন, তার ছেলে সেলিম মাদকাসক্ত হলে তাকে ‘ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ ভর্তি করা হয় তিন বছর আগে। তারা হতদরিদ্র বলে সেসময় সাত হাজার টাকা দিলেও পরে আর টাকা দিতে পারেননি।

এরপর থেকেই টাকার জন্য তার ছেলেকে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন আটকে রাখার পর তাদের কাছে ছেলেকে ফেরত পাওয়ার জন্য তিন লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার সহায়তায় গত ২৫ নভেম্বর তাকে উদ্ধার করা হয়।

তার ছেলেকে নির্যাতন করে আরও অসুস্থ করে তোলা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।


এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফিরোজা নাজনীন বাঁধন বলেন, “এই রোগীর পরিবারের অভিযোগ সঠিক নয়। তারা দীর্ঘদিন এই রোগীকে এখানে ফেলে রেখে আর কোনো খোঁজ নেয়নি। তার কাছে আমাদের অনেক টাকাও পাওনা ছিল।”
গাজীপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, গাজীপুরে নিবন্ধিত ২২টি মাদকাসক্তি নিরাময় বা পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও ছয় মাস আগে একটি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সকলেই এক সময় কম-বেশি মাদকসেবী ছিলেন।

“সনদধারী এসব প্রতিষ্ঠানে কাগজ-পত্রাদি যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, দুয়েকটি মাদকাসক্তি নিরাময় বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে অনেকে শর্ত পালন করলেও বেশিরভাগই রেজিস্ট্রেশনের শর্ত শতভাগ মানছে না।”

শামীম হোসেন আরও জানান, সরকারি বিধি অনুযায়ী বেসরকারি দশ বেডের মাদক নিরাময় কেন্দ্রের জন্য সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস চিকিৎসক, একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক, দুইজন প্রশিক্ষিত সেবক, একজন সুইপার থাকার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি বেডের জন্য থাকতে হবে ৮০ বর্গফুট জায়গা। বিনোদনের পর্যাপ্ত সুবিধাসহ আধুনিক প্যাথলজিক্যাল ল্যাব থাকারও বিধান রয়েছে।

কিন্তু গাজীপুরের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এসবের বালাই নেই বলে জানান তিনি।

২০০৫ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানি, নার্স, ওয়ার্ডবয়, সুইপার থাকতে হয়। রোগীদের সরবরাহকৃত খাবারের তালিকা, রোগীদের মানসিক বিনোদনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের সুবিধা, প্রয়োজনীয় শৌচাগার, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের জন্য ক্লাশরুম ইত্যাদি থাকার বিধান রয়েছে।

কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে এই আইনের বিধিমালা শতভাগ মানা হচ্ছে না বলে জানান শামীম।

এসব প্রতিষ্ঠানের সকল তথ্যাদি ঢাকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখান থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পরই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরও জানান, সরকারিভাবে ছয়টি বিভাগে একটি করে মানসিক চিকিৎসালয় বা পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ে এই ধরনের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এই কারণে দেশে বেসরকাভিাবে মাদকাসক্তি নিরাময় বা পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। তবে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে মাদকসক্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একটি উইং খোলা হলে এসব রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেত এবং তাদের নানা হয়রানি কমত।