• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

টিকায় এগিয়ে বাংলাদেশ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০২১  

নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণ যেমন অসম্ভবকে ‘সম্ভব’ করেছে বাংলাদেশ; তেমনি করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রমও বাস্তব রূপ দিচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলোতে করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে টিকা দ্রুত শুরু হবে এটা ছিল কল্পনা। সেই কল্পনা বাস্তব রূপ পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে সময়োপযোগী দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে। আমেরিকা-ইউরোপের কিছু দেশ ছাড়া উন্নত অনেক দেশ এখনো করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান আরো পিছনে। কিন্তু ভারত করোনা টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে। ওই দেশটির পরই বাংলাদেশের মানুষ বৈশ্বিক মহামারির অদৃশ্য ভাইরাস করোনা টিকা পাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের ‘ফার্স্ট রান’ উদ্বোধন করবেন। প্রথম টিকা গ্রহণ করে করোনা ইতিহাসে নাম লেখাবেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ তিন নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা, মুন্নী খাতুন ও রিনা সরকার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ‘ফার্স্ট রান’ শুরুর পর আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গতকাল অনেক উন্নত দেশের আগে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া অসম্ভবকে সম্ভব করার চিত্র তুলে ধরে টিকা সংরক্ষণ ও প্রয়োগের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্র্শী নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ অনেক দেশের আগেই টিকা পেয়েছে।

করোনা টিকা পাবে কি-না তা নিয়ে বিশ্বের শতাধিক দেশ এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছে। বিশ্বের সম্পদশালী কয়েকটি দেশ আগেই উৎপাদিত টিকার প্রায় ৯০ ভাগ ক্রয়ের জন্য বুকিং দিয়েছেন। তাছাড়া জনস হপকিনস সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির মতে টিকা সংরক্ষণে প্রায় ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। বিশ্বের অনেক দেশের বড় শহরের হাসপাতালগুলোতে এত কম তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। সারা বিশ্বে কার্যত টিকা নিয়ে চলছে হাহাকার। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (ইইউ) অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার জানিয়েছে, তারা চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ করতে পারছেন না। কোরিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলংকার মতো দেশ এখনো টিকার ব্যাপারে ‘কিছু শুরু’ করতে পারেনি। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশের নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করার প্রতি জোর দিয়েছেন। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেরই টিকা পাওয়ার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি টিকা সংরক্ষণের প্রস্তুতি নিতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। পরিকল্পিতভাবে ত্বরিৎ গতিতে টিকাদান কর্মসূচি ‘ফার্স্ট রান’ শুরু হচ্ছে। এমনকি সরকারি পর্যায় ছাড়াও বেসরকারি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা অর্জন করেছে।

সকল অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে ভারত সরকার গত ২১ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহ-উৎপাদক দিল্লির সেরাম ইনস্টিটিউটের ২০ লাখ ডোজ টিকা ‘উপহার’ হিসেবে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এর চার দিন পর ভারত থেকে বাংলাদেশে সংগ্রহ চুক্তির আওতায় কোভিশিল্ডের ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান এসে পৌঁছেছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় যে তিন কোটি ভ্যাকসিন ডোজ আসার কথা এই চালান তারই অংশ। এর আগে ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে টিকা আমদানির বিষয়ে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউট ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশের বিক্রি করবে। আর প্রতিমাসে বাংলাদেশে ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। কিন্তু সেরামের এক কর্মকর্তার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লে ব্যপক হৈচৈ শুরু হয়।

টিকা দেয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকার ৫টি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে ৭ ফেব্রæয়ারিতে সারাদেশে টিকা দেয়া শুরুর আগে সারাদেশে শতাধিক হাসপাতাল প্রস্তুতের কাজ চলছে। গতকাল ২৬ জানুয়ারি বহুল প্রতীক্ষিত করোনা টিকা পেতে ইচ্ছুকদের অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রথম একজন নার্সের শরীরে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দেশে করোনা টিকা দেয়ার ঐতিহাসিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লেখাবে বাংলাদেশ। ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কর্মসূচি আরো গতি পাবে এদিনই এই হাসপাতালে সম্মুখ সারিতে থাকা বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্বকারী ২৪ জনের একটি দলকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে। সেই তালিকায় চিকিৎসক, নার্স, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সাংবাদিকসহ অন্য পেশার মানুষ যুক্ত থাকবেন। আর ২৮ জানুয়ারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে আরো চারটি হাসপাতালে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী জেনারেল হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। হাসপাতালগুলোর পরিচালকরা জানান, টিকা কর্মসূচি চালু করতে তারা প্রস্তুত। তবে তাদের কেউ কেউ বলছেন, জাতীয়ভাবে কর্মসূচি চালুর প্রথমদিন যদি সবকিছু ঠিকভাবে করা যায়, তাহলে মানুষের আস্থা আসবে, ধীরে ধীরে টিকা নিতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে।

স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান জানান, রাজধানীর ৫ হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দিয়েই এ কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে, তাদের মধ্যে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি-না সেটা দেখা হবে।

জানা গেছে, প্রথম মাসে উপহারের ২০ লাখ ও চুক্তির ৫০ লাখ ডোজ মিলে ৭০ লাখ ডোজ টিকার ভেতরে ৬০ লাখ টিকা দেয়া হবে। দ্বিতীয় মাসে দেয়া হবে ৫০ লাখ। তৃতীয় মাসে দেয়া হবে আবার ৬০ লাখ। প্রথম মাসে টিকা পাওয়াদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে তৃতীয় মাসে। আর এ হিসাবে টিকা বিতরণ পরিকল্পনা করা হয়েছে। টাকা দিয়ে কিনে নেয়া টিকা দেশে আসার পর ঢাকা থেকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস চুক্তি অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে টিকা সরবরাহ করবে।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, টিকা নেয়ার প্রস্তুতি মোটামুটি ভালোই। এ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, টেকনোলজিস্ট, আনসারসহ সব বিভাগের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ১০০ জনকে বাছাই করা হয়েছে। তবে আমাদের অনেক চিকিৎসক আগ্রহী প্রথম দিনেই টিকা নিতে। তবে কলিগদের টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে আমি নিজে হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে প্রথম টিকা নিতে আগ্রহী।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ জানান, প্রথম দিন টিকা দেয়ার জন্য হাসপাতালের ১০০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫০ জনের আরেকটি টিম স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ম্যানেজমেন্ট টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। গ্রহণকারীদের পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য ২০টি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। সঙ্গে রাখা হয়েছে চার বেডের আইসিইউ ইউনিট।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আমিন জানান সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচির জন্য হাসপাতালে মোট আটটি বুথ থাকবে। প্রতিটি বুথে টিকা দেয়ার জন্য দুইজন নার্স এবং চারজন করে স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। টিকা দেয়ার পর পোস্ট ওয়েটিং রুমে টিকা গ্রহীতাদের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে তারা ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণে থাকবেন। ৮টি অবজারভেশন বেড প্রস্তুত করা হয়েছে জীবনরক্ষাকারী সব ধরনের ওষুধ এবং যন্ত্রপাতিসহ। সেখানে টিকা নেয়া ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই সময়ে কারো অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন হলে হাসপাতালের সি বøকে ১০ তলায় চারটি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) হিসেবে। এই সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য থাকবে একটি মেডিক্যাল টিম এবং স্ট্যান্ডবাই আরেকটি মেডিক্যাল টিম থাকবে যেখানে একজন ইন্টারনাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট, দুইজন রেসিডেন্স এবং একজন আইসিইউ স্পেশালিস্ট থাকবেন।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ জানান, টিকা রাখার জন্য হাসপাতালে আইএলআর (হিমায়িত বাক্সের মধ্যে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা) ফ্রিজে তিন হাজার টিকা রাখার ব্যবস্থা আছে। এ হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, টেকনোলজিস্টসহ মোট ১ হাজার ৪৭ জন কর্মীর মধ্যে দেড়শ কর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হাসপাতালের ভেতরে টিকার সাইটে ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের কিছু ভাইটাল বিষয় যেমন রক্তচাপ, ফুসফুসের অবস্থা এবং অ্যালার্জির কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা-এসব কিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে তাকে টিকা দেয়া হবে, সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে ৩০ মিনিটে। আর তাদের দেখার জন্য থাকবে একটি মেডিক্যাল টিম। যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে তারা বাসায় চলে যাবে এবং তখন তাদের একটি টেলিমেডিসিনের জন্য ফোন নম্বর দেয়া হবে। যদি বাড়ি যাওয়ার পর কোনো সমস্যা হয় তখন ওই নম্বরে তিনি কল করে প্রয়োজনীয় সেবা নেবেন।

কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ডা. এ কে এম সরয়ার উল আলম জানিয়েছেন, এ হাসপাতালের এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি চলছে, এখনও ফাইনাল হয়নি। যারা টিকা দেবেন-তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। এ হাসপাতালে কারা টিকা নেবেন তাদের তালিকা হচ্ছে, যাচাই বাচাই চলছে।

এর আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গতকাল মঙ্গলবার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সরকারিভাবে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ টিকার মানবদেহে প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেলে মাহবুবুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছেন। রাজধানীর মহাখালীতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, টিকার প্রতিটি লটের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। বুধবার এই টিকা দিয়েই শুরু হবে করোনাভাইরাসের টিকাদান।