• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেয়েই বুক জ্বালা অতঃপর মৃত্যু হয় ভাওয়াল রাজার

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০১৯  

মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ১৯০২ সালে বিয়ে করেন অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতীকে। যদিও বিয়ের পর থেকেই ভাওয়াল রাজবাড়িতে রানী হিসেবে তিনি বিলাসবহুল জীবযাপন করছিলেন। তবুও বিভাবতী তেমন সুখী ছিলেন না। মেজো কুমারের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণাবলিই ছিল না। তিনি শিকারে যেতেন, টমটম হাঁকাতেন। চেহারা রাজাদের মতো হলে কী হবে, চালচলন, পোশাক-আশাকে তাকে রাজপরিবারের সদস্য বলে মনে হতো না। 

অন্য দুই কুমারের মতো বেহায়াপনার সঙ্গে বাড়তি যা বলার ছিল তা হলো মেজো কুমার কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এমনিতে রমেন্দ্র নারায়ণ মানুষ খারাপ ছিলেন না, প্রজাবৎসলও ছিলেন। তবে দু’টো বাজে স্বভাব ছিল তার, পানের নেশা আর নারীর নেশা। শিকারের ভীষণ শখ ছিল তার। বিভাবতীর মত অনিন্দ্যসুন্দরীও  তাকে মদ আর নারীসঙ্গ থেকে দূরে রাখতে পারেনি।

যা হবার তাই হলো একটা সময়ে, সিফিলিসে আক্রান্ত হলেন রমেন্দ্র নারায়ণ। স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব আগে থেকেই ছিল তার। শোনা যায় বিভাবতীও নাকি স্বামীর আচরণে বিরক্ত হয়ে বহুগমনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। রমেন্দ্র নারায়ণের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের সঙ্গে রানী বিভাবতীর প্রণয় ছিল বলেও দাবি করেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। 

 

ভাওয়াল রাজা ও রানী বিভাবতী

ভাওয়াল রাজা ও রানী বিভাবতী

১৯০৭ সালে রাজমাতা রানী বিলাসমণির মৃত্যু হলে ভাওয়াল রাজপরিবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বীজ বপন হয়। মেজো কুমারের রোগ দেহে বাড়তে থাকলে সবাই বুঝতে পারেন ঢাকার চিকিৎসকেরা রোগের নিদান দিতে পারছেন না। এজন শিগগিরই কলকাতায় যাওয়া চাই। রাজমাতার মৃত্যুর পর পরই ১৯০৮ সালে রানী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজবাড়িতে প্রবেশ করেন। সত্যেন্দ্র রাজবাড়িতে এসেছিলেন শিলং এ ডেপুটির চাকরি নেবেন বলে। 

কিন্তু জমিদারি পরিচালনায় কুমারদের দুর্বলতা দেখে জেঁকে বসেন রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতে রানী বিভাবতীর চেয়ে বেশি প্রতাপে চলতেন তিনি। মেজো কুমারকে কলকাতায় চিকিৎসা করানোর জন্য যারা সঙ্গে গিয়েছিলেন তাদের মাঝে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন। ১৯০৯ সালের এপ্রিলে রমেন্দ্র নারায়ণের শরীর ভেঙে পড়লো ভীষণ। ব্যক্তিগত চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত তাকে পরামর্শ দিলেন দার্জিলিং এ গিয়ে হাওয়া বদল করে আসতে। তাতে যদি কিছু হয়। সেখানে বনে বাদাড়ে শিকারও করা যাবে, এরকম লোভ দেখানো হয়েছিল রমেন্দ্র নারায়ণকে। 

দলবল নিয়ে দার্জিলিং যাত্রা করলেন ভাওয়াল এস্টেটের মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ। সঙ্গে আরও ছিলেন রানী বিভাবতী, তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ, চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তসহ আরও প্রায় বিশজন। যাত্রা শুরুর দুইদিন পর দার্জিলিঙে পৌঁছালেন তারা। দার্জিলিঙে গিয়ে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলো রমেন্দ্র নারায়ণের। সেখান থেকে প্রতিদিন ভাওয়াল এস্টেটের জমিদার বাড়িতে মেজো কুমারের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠানো হতো। 

প্রথম টেলিগ্রামে তার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, পরের টেলিগ্রামে জ্বর বৃদ্ধি, পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি খবর আসতে থাকে। মে মাসের ৫ তারিখের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়লে আশু ডাক্তার তাকে পেট ফাঁপার ওষুধ দিয়েছিলেন। তবে ৬ মে ১৯০৯ সালে রাত ৩টার দিকে মেজো কুমার আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেজো কুমারের অবস্থা দেখে আশু ডাক্তার সে রাতে আর ওষুধ দেননি বরং পর দিন সিভিল সার্জনের কাছে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করেন। স্ত্রী বিভাবতী যথাসম্ভব স্বামীর কাছে থাকতে চাইলেও তার ভাই সত্যেন্দ্র চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো মেজো কুমারকে আলাদা ঘরে রাখেন। 

‘এ যে ছিল রাজা’ ছবির দৃশ্যে রাজার মৃত্যু!

‘এ যে ছিল রাজা’ ছবির দৃশ্যে রাজার মৃত্যু!

রাজার মৃত্যু

সিভিল সার্জন এক ধরনের মিঙ্চার মেজো কুমারকে খেতে দিয়েছিলেন। মেজো কুমারের অবস্থা কখনো-সখনো ভালোর দিকে গেলেও আসলে খারাপের দিকেই এগোচ্ছিল। ৮ মে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের ডাক্তার ক্যালভার্ট মেজো কুমারের যন্ত্রণা দেখে মরফিয়া ইনজেকশন দিতে চাইলেন কিন্তু মেজো কুমার রাজি হননি। অবশ্য বিকালের দিকে মেজো কুমার ইনজেকশন নেন এবং এতে করে পেটের ব্যথা কমে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার বমি ও রক্তমিশ্রিত পায়খানা করার কারণে ভয়াবহ রকমের দুর্বল হয়ে পড়েন।

রানী বিভাবতীর মামা একজন ডাক্তার নিয়ে আসেন। তার নাম বিবি সরকার। ডাক্তার মেজো কুমারের অবস্থা দেখে যান। তখন মেজো কুমারের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়, গা শীতল হয়ে গেছে। ডাক্তার সরকার মেজো কুমারকে মৃত বলে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন বলে জানা গেলেও স্ত্রী বিভাবতী সেটা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। এখানে একটি রহস্যের সৃষ্টি হয়, মেজো কুমার কখন মারা গিয়েছিলেন? সন্ধ্যায় নাকি মাঝরাতে? স্টপ অ্যাসাইড বাড়ির দারোয়ানসহ অনেকেই বলেছেন, মেজো কুমার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন।

অথচ মেজো রানী ও তার ভাই সত্যেন্দ্র সবসময় বলে এসেছেন মেজো কুমার মাঝরাতে মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দার্জিলিঙের সিভিল সার্জন গলব্লাডারে পাথরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। পরদিন, ৮ই মে দার্জিলিঙেই মেজো কুমারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। ভাওয়ালরাজার গল্পের মূল রহস্যটা শুরু হয় এখান থেকেই। সেদিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মেজো কুমারের দেহটা শ্মশানের বাইরে রাখা ছিল, কাঠকয়লা দিয়ে মুড়িয়ে। 

এরমধ্যেই শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। সবাই শরীর বাঁচাতে ঢুকে পড়েছিল চাতালের ভেতরে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন বৃষ্টি থামলো, তখন রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া গেল না আর! যে কয়জন ছিলেন সেখানে উপস্থিত, তারা বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কিছু না পেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। শ্মশানের শেয়াল কুকুরে মৃতদেহ নিয়ে গেছে ভেবে তারা চলে গেলেন শেষমেশ। ১০ মে সকালে মেজো কুমারের মৃত্যুর খবর টেলিগ্রাম করে সবাই দার্জিলিং ত্যাগ করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা করেন। ১১ মে মধ্যরাতে মেজো রানী জয়দেবপুরে ফিরে আসেন। রাজবাড়িতে শোকের ছায়া নেমে পড়ে। 

১৮ মে মেজো কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল। এসময় গুজব ছড়িয়ে গেল মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের মৃতদেহের শ্রাদ্ধ নাকি ঠিকভাবে করা হয়নি। কোনোমতে গুজব এড়িয়ে শ্রাদ্ধ করা হলেও গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে হিসাবের গোলমালে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার সেনের চাকরি তখন যায় যায়, সত্যেন্দ্র তার বোনকে নিয়ে ম্যানেজার সেনের সঙ্গে পরামর্শ করে মিস্টার সেনের পরিবর্তে মিস্টার নিডহাম নামক এক নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দিলে ষড়যন্ত্র আরও গভীরে ঠেকে। 

অবশ্য ষড়যন্ত্র ছাড়াই রাজবাড়ির কর্তৃত্ব নেয়া হলো। কারণ তিন বছরের ব্যবধানে ছোটকুমার ও বড় কুমার মারা গেলে রাজবাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। অন্যদিকে, রানী বিভাবতী আর তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ জমিদারবাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন কলকাতায়। রাজবাড়ির তিন রানীই ছিলেন সন্তানহীনা এবং তারা সবাই কলকাতায় পাড়ি জমান। ভাওয়াল এস্টেটের অবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছিল মেজো কুমার জীবিত আছেন এবং তিনি একদিন ফিরে আসবেন এ গুজব ততই শক্তিশালী হচ্ছিল। ফলে বৃটিশ সরকার পুরো জমিদারী নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিলো একটা সময়ে।

 

রাজার আবির্ভাব

রাজার আবির্ভাব

সন্ন্যাসী রুপে রাজার আবির্ভাব

বারো বছর পরের একদিন, সাল ১৯২১। যে মে মাসে রমেন্দ্র নারায়ণ মারা গিয়েছিলেন, সেই মাসেই ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় জটাধারী এক সুদর্শন সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া গেল। তার চেহারা অবিকল রমেন্দ্র নারায়ণের মতো! যারা রমেন্দ্র নারায়ণকে দেখেছে, তারা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলো এই সন্ন্যাসীকে দেখে। এক কান দুই কান হয়ে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না খুব বেশি। ভাওয়াল এস্টেটেও এই খবর গিয়ে পৌঁছে গেলো। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। 

খবর শুনে দলবেঁধে তাকে দেখতে এলেন এলাকার মানুষ। মৃত্যুর বারো বছর পরে মেজো কুমার ফিরে এসেছেন, এ তো চাট্টেখানি কথা নয়! খবর দেয়া হলো রমেন্দ্র নারায়ণের ছোট বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে এলেন তিনি। সন্ন্যাসীকে দেখেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন জ্যোতির্ময়ী। একদম অবিকল তার মেজো ভাইয়ের মতো দেখতে এই লোক! শুধু জটাধরা চুল বাদে পুরো অবয়বটাই যেন রমেন্দ্র নারায়ণের। খালি গায়ের সন্ন্যাসীকে ভালো করে পরখ করলেন জ্যোতির্ময়ী, শিকারে গিয়ে কয়েকবার আঘাত পেয়েছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণ, এছাড়াও শরীরে ছিল জন্মদাগ। মিলিয়ে দেখা হলো সেগুলো, শতভাগ মিলে গেল সব! 

সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করা হলো তার আসল পরিচয়ের ব্যাপারে, কিন্তু তিনি বেশিকিছু বললেন না। শুধু জানালেন, পরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন তিনি। রমেন্দ্র নারায়ণ নামের কাউকে তিনি চিনতেন না বলেও জানিয়ে দিলেন। কিন্ত বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করলেন না তার কথা। লোকের আগ্রহে বিরক্ত হয়ে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চলে গেলেন সন্ন্যাসী। কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফিরলেন তিনি। আবার মানুষজন ভীড় করতে লাগলো তাকে দেখতে। 

তার ফিরে আসার খবর পেয়ে জমিদার অতুল প্রসাদ রায়চৌধুরী আবার তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। কয়েক এলাকার জমিদারেরা মিলে বসলেন আলোচনায়, একটা কিছু সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে এই সন্ন্যাসীর ব্যাপারে। খবর এলো, সন্ন্যাসী গিয়ে বসেছেন ভাওয়াল এস্টেটের রাজবাড়ির সামনে, তাকে ঘিরে আছে উৎসুক জনতা। সম্ভবত তিনি ঠিক করেছেন, নীরবতা ভেঙে এবার মুখ খুলবেন। শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সন্ন্যাসী মনে করতে পারলেন তার দুধ মায়ের নাম, সেটা রাজপরিবারের বাইরে আর কেউই জানতো না। 

রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত ছিলেন সেখানে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দার্জিলিঙে আসলে কি হয়েছিল? প্রতিটা ঘটনার সঠিক জবাব দিয়ে গেলেন সেই সন্ন্যাসী। ইনিই যে মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ, সেটা নিয়ে কারো আর সন্দেহ রইলো না। প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। 

এছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসাবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রর জন্য ছিলো অশনিসংকেত। শেষ পর্বটি পড়ার জন্য ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকুন।