• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

নবীদের বুদ্ধিদীপ্ত কিছু শিক্ষনীয় ঘটনা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

এ পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবী রাসূলরা। তাদের জ্ঞান ও মেধা অন্যান্য সকল সাধারণ মানুষের উর্দ্ধে। তাদেরকে বিশেষ গুণাবলী দিয়ে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। 

নবীদের বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে প্রখর ও তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ আছে-

ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর দুই স্ত্রী:
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সম্মানিতা স্ত্রী হজরত সারা (রা.) বুঝতে পারলেন, ইব্রাহিম (আ.) অন্য স্ত্রী হজরত হাজেরার প্রতি বেশি আসক্ত। স্বভাবজাত মানবীয় আত্মমর্যাদাবোধের কারণে হজরত সারা কঠোর হলেন। এবং একটি কঠিন কসম করে বললেন, আমি হাজেরার কোনো এক অঙ্গকে অবশ্যই কেটে ফেলব।

হজরত হাজেরা যখন এই নিষ্ঠুর কসমের বিষয়টি জানতে পারলেন তখন নিজেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে লৌহবর্ম পরিধান করা শুরু করলেন এবং জামার হাতা ও ঝুল লম্বা রাখতে লাগলেন। তিনিই সর্বপ্রথম এভাবে মেয়েদের লম্বা পোশাকের প্রচলন ঘটালেন। লম্বা ঝুলবিশিষ্ট পোশাক পরে চলার সময় মাটিতে পোশাকের নিচের অংশ অনেক খানি লেগে যেত, ফলে মাটিতে যে পায়ের ছাপ পড়তো তার ওপর পোশাকের পিছনের অংশ পড়ে পায়ের ছাপ মুছে যেত। যদ্বারা হজরত সারা বুঝতে পারতেন না যে তিনি (হাজেরা) কোন পথ দিয়ে যাতায়াত করেন।

এটা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর কানে গেলে তিনি সারাকে বললেন, তুমি তো বাড়াবাড়ি রকমের কসম খেয়ে বসে আছ। যদি কল্যাণ চাও তাহলে বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দাও। হাজেরাকে কষ্ট দেয়ার চিন্তা পরিহার কর। সারা বললেন, তা না হয় করলাম। কিন্তু আমি তো কসম করে ফেলেছি। এটা কীভাবে সম্পন্ন করব? হজরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন, তুমি হাজেরার এমন কোনো অঙ্গ কেটে ফেলো যা দ্বারা তোমার কসমও সম্পন্ন হয়ে যাবে, কিন্তু তার সৌন্দর্যের কোনো হানি হবে না। বরং এ দ্বারা তার আরো উপকার হয় এবং উপকারি হওয়ার কারণে তা ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যায়।  হজরত সারা বিষয়টি বুঝতে পারলেন এবং তিনি হাজেরার লজ্জাস্থানে খতনা করে তার কসম সম্পন্ন করলেন।

তখন থেকে আরবদের মধ্যে মহিলাদের খতনা করার রেওয়াজ চালু হলো। যা এখনো প্রচলিত। তবে ইসলাম শুধু পুরুষদের জন্য খতনা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে, মেয়েদের জন্য নয়। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি হজরত ইব্রাহিম (আ.) অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে হজরত সারাকে কসম ভঙ্গ হওয়া থেকে বাঁচালেন এবং হজরত হাজেরাকে অঙ্গহানি ও শারীরিক ত্রুটি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন। 

চৌকাঠ পরিবর্তন:
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হজরত ইসমাঈল (আ.) জুরহুম গোত্রে প্রথম বিবাহ করলেন। একদিন তার পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) পুত্রের নিকট বেড়াতে মক্কা এলেন। হজরত ইসমাঈল (আ.) তখন ঘরে ছিলেন না। জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তাঁর পুত্রবধু ঘরে বসালেন। তিনি তার পুত্রবধুকে সংসারের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন।  সাধারণভাবে নারীদের যা স্বভাব। এ নারীও তার ব্যতিক্রম করলেন না। কথা বলার সুযোগ পাওয়া মাত্রই অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসলেন। অভাব অনটন, অশান্তির কথা বলা শুরু করলেন।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) সব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। মুখে কোনো অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেন। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখেই বললেন, তাহলে আজ আমি উঠি। একটা কথা, তোমার স্বামী ফিরলে তাকে বলবে যেন ঘরের চৌকাঠ পরিবর্তন করে ফেলে। হজরত ইসমাঈল (আ.) ঘরে ফিরলে স্ত্রী সব ঘটনা খুলে বললেন।

শুনে ইসমাঈল (আ.) সব বুঝতে পারলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, যিনি এসেছিলেন তিনি আমার পিতা। ঘরের চৌকাঠ পরিবর্তনের কথা বলে তিনি তোমাকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য ব্যবহার করে নিজ উদ্দেশ্যের কথা পুত্রকে বুঝিয়ে দিলেন এবং পুত্রবধুকে সরাসরি বুঝতে দিলেন না।

মায়ের মমতা:
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, দু’জন নারী একই কাফেলায় সফর করছিলেন। উভয়ের সঙ্গেই দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল। একদিন দুর্ভাগ্যক্রমে রাতের অন্ধকারে একজনের শিশুকে নেকড়ে তুলে নিয়ে গেল। শিশু হারানোর ভয়াবহ বেদনায় নারীটি দিশেহারা হয়ে গেল। কষ্ট কিছুটা প্রশমিত হয়ে এলে তার ভেতরে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ভাবল আমি আমার বাচ্চা হারিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছি। সুতরাং সফরসঙ্গী নারীকেও বাচ্চা নিয়ে শান্তিতে থাকতে দেব না।

কী করা যায়? হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে এল, আরে আমাদের উভয়ের বাচ্চা তো দেখতে অনেকটা একই রকম। ওকে বাচ্চা ছাড়া করতে হলে ওর বাচ্চাটাকে আমার বাচ্চা বলে দাবী করলেই হয়। কাফেলার লোকজন কারো বাচ্চাকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। পরদিন সে অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলে দাবী করে বসল। ঝগড়া যখন তুমুল আকার ধারণ করল, কাফেলার লোকেরা তাদেরকে হজরত দাউদ (আ.) এর নিকট বিচারের জন্য নিয়ে গেল। তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তাই উভয়কে মানতে হবে।  হজরত দাউদ (আ.) দুর্ভাগ্যবশতঃ হিংসুক নারীর স্বপক্ষে রায় দিলেন।

এতে বাচ্চার প্রকৃত মা নিতান্ত কষ্ট পেলেও কিছুই করার ছিল না। বাদশাহের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। যখন উভয়ই ফিরে যাচ্ছে তখন হজরত সুলাইমান (আ.) এর সঙ্গে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সমস্যার কী সমাধান হলো? তারা তাঁকে সব খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, এ মামলার রায় যা দেয়া হয়েছে তা বাতিল। আমি যা সিদ্ধান্ত দেব তাই কার্যকর হবে। ইনসাফ হলো বাচ্চাকে দু’টুকরো করে উভয়কে সমান সমান দিয়ে দেয়া।

তিনি কাউকে ডাক দিলেন, এই কে আছিস, একটা বড় ছুরি নিয়ে আয়। বাচ্চাকে আমি দু’টুকরো করব। এ কথা শুনে বাচ্চার প্রকৃত মায়ের বুক ভীষণভাবে কেঁপে উঠল, সে করুণ কন্ঠে বলল, আসলেই কি আপনি বাচ্চাকে দু’টুকরো করবেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। প্রকৃত মা বললেন, এ হতে পারে না। বাচ্চার প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। এ বাচ্চা ওই নারীর কাছেই থাকুক। আমি বাচ্চা চাই না। তবুও হুজুর, বাচ্চাকে দু’টুকরো করবেন না। হজরত সুলাইমান (আ.) সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, মূলত ইনিই বাচ্চার আসল মা। প্রকৃত মা কখনো নিজের চোখের সামনে সন্তানকে দু’টুকরো করা দেখতে পারে না। তাই প্রকৃত মায়ের নিকট বাচ্চা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিলেন। 

দুষ্টু জ্বীন:
উবায়দুল্লাহ ইবনে উবাইদ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, একবার হজরত সুলাইমান (আ.) এক অবাধ্য জ্বীনকে গ্রেফতার করে দরবারে হাজির করতে বললেন। যখন সে দরজার নিকট আসল তখন সকলের অগোচরে একটি কাঠ দরজার ওপর দিয়ে এমনভাবে ছুঁড়ে মারল যা সুলাইমান (আ.) এর সামনে গিয়ে পড়ল। তিনি যাচাই করে জানতে পারলেন, এটা গ্রেফতারকৃত জ্বীনেরই কাজ। তিনি দরবারের লোকদের বললেন, এই কাঠের টুকরাটি নিক্ষেপ করে সে বুঝাতে চায়, তোমরা আমার সঙ্গে যে আচরণই করো না কেন একদিন তোমাদের অবস্থাও এই কাঠের মতো হবে। এই কাঠটিও জমিন থেকে একদিন সজীব ও তরুতাজা হয়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু আজ তা শুকনো কাষ্ঠ খণ্ডে পরিণত হয়েছে। তেমনি তোমাদের অবস্থাও একদিন এমনই হবে। এ কথা বলে তিনি দরবারি লোকদের বুঝাতে চেয়েছেন, সে কাঠের টুকরাটি কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়নি। নয়তো দরবারের লোকেরা তাকে হত্যা করত। 

হত্যাকারীর রেহাই নেই:
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর থেকে বর্ণিত, একবার সুলাইমান (আ.) দরবারস্থ লোকদের নিয়ে কোথাও বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে দেখলেন এক নারী তার ছেলেকে ‘লা দ্বীন’ অর্থাৎ কোনো ধর্ম নেই বলে ডাকছে। এটা শুনে সুলাইমান (আ.) এর মনে খটকা লাগল। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। যাত্রা বিরতি দিয়ে তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘সঠিক ধর্ম’ তো আছে। তবুও এ কথা কেন বলছ? নারী বললেন, আমার স্বামী ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সফরে গিয়েছিলেন। তার ব্যবসায়িক পার্টনার একদিন আমার নিকট এসে বললেন, আপনার স্বামী সফরে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে ওসিয়ত করে গিয়েছেন যদি আমার ছেলে সন্তান হয় তাহলে যেন ‘লা দ্বীন’ নাম রাখি। হজরত সুলাইমান (আ.) এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চিন্তায় ডুবে রইলেন। পরবর্তীতে সুলাইমান (আ.) নারীর স্বামীর ব্যবসায়িক পার্টনারকে খুঁজে বের করে কঠিনভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সত্য সত্য বল ঘটনা কী হয়েছে? নিশ্চয়ই তুমি লোকটিকে হত্যা করেছ। এভাবে জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করল, সেই লোকটিকে হত্যা করেছে। হজরত সুলাইমান (আ.) কিসাসস্বরূপ লোকটিকে হত্যা করলেন। 

চোরের মাথায় পশম:
মুহাম্মদ ইবনে কাআব কুরতী (র.) বর্ণনা করেন, একবার এক ব্যক্তি হজরত সুলাইমান (আ.) এর নিকট এসে বলল, আল্লাহর নবী, আমার হাঁসটি চুরি হয়ে গেছে। হজরত সুলাইমান (আ.) এ কারণে লোকদেরকে একত্রিত হতে বললেন। সবাই জমা হলে তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যেই একজন প্রতিবেশীর হাঁস চুরি করেছে। কিন্তু কী বোকা! হাঁসের পশম এখনো তার মাথায় লেগে আছে। এ কথা শুনে চোর তৎক্ষণাৎ মাথায় হাত দিল। সুলাইমান (আ.) বুঝে ফেললেন, সেই চুরি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাকড়াও করে ফেললেন।

হজরত ঈসা (আ.) ও শয়তান:
শয়তান একবার হজরত ঈসা (আ.)-কে বলল, তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এর বাইরে কিছুই হবে না। হজরত ঈসা (আ.) বললেন, হ্যাঁ, আমি তা বিশ্বাস করি। তাহলে এক কাজ করো, এই পাহাড়ের উপর উঠে নিচে লাফিয়ে পড়ো। তোমার ভাগ্যে মৃত্যু লেখা থাকলে মরবে, নয়তো মরবে না। হজরত ঈসা (আ.) বললেন, আরে মরদুদ! আল্লাহ বান্দাকে পরীক্ষা করতে পারেন; কিন্তু আল্লাহকে পরীক্ষা করার অধিকার বান্দার নেই।