• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

নরখাদকের দ্বীপ ‘নর্থ সেন্টিনেল’

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০১৮  

আন্দামানের রহস্যঘেরা আদিম দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল। ২৮ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটিতে বাস করেন নরখাদক আদিম জাতি সেন্টিনেল। এ দ্বীপটি সভ্যতার মাঝে থাকলেও এর অধিবাসীদের এখনো সভ্য করা যায়নি। এমনকি কেউ সেখানে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেননি। সেখানে কেউ গেলে তাকে হত্যা করে খেয়ে ফেলে এই আদিম অধিবাসীরা।

সম্প্রতি এক মার্কিন নাগরিক সেখানে গেলে তাকে হত্যা করে সেন্টিনেলরা। এরপর পুলিশ এ ঘঠনায় খুনের মামলা দায়ের করেছে। ওই মার্কিন নাগরিককে দ্বীপে পৌঁছে দেয়ার দায়ে সাত জেলেকে গেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে সেই দ্বীপে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করার দু:সাহস দেখায়নি কেউ।

আজ পর্যন্ত কোনো অভিযাত্রী রহস্যঘেরা দ্বীপের ঘন জঙ্গলের অধিবাসীদের জীবন নিয়ে চর্চা করতে পারেননি। যারা গিয়েছেন, হয় সেন্টিনেলদের দেখা পাননি, নয়ত তিরের মুখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন অথবা জীবন দিয়েছেন। ভাগ্যক্রমে যারা তাদের দু একজনকে দেখেছেন তারা বলেছেন, ওদের গলায়-বুকে-পিঠে হাড় আর খুলির গয়না। কঙ্গোর জঙ্গলের কিগ্যানি বা অস্ট্রেলিয়ার বুশম্যানদের মতো সেন্টিনেলরা বিশ্বের বিরলতম উপজাতিগুলোর একটি। যারা গত ৬৫ হাজার বছর ধরে (শেষ তুষারযুগেরও আগে) এই দ্বীপের বুকে বসবাস করছেন। বুধবার মার্কিন মিশনারি জন অ্যালেন চাও প্রাণ হারানোর পর বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ওই দ্বীপকেই বলছে ‘বিশ্বের ভয়ঙ্করতম’।

ভয়ঙ্করতম এই দ্বীপের কুখ্যাতি বহু দিনের। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত রোমান জ্যোতির্বিদ টলেমি লিখেছিলেন বঙ্গোপসাগরের এই ‘নরখাদকদের দ্বীপ’ নিয়ে। ১২৯০ সালে মার্কো পোলোও বর্ণনা দেন এমন এক দ্বীপের, যেখানে হিংস্র ও বর্বর আদিবাসীরা বসবাস করেন। যারা সভ্য মানুষ পেলেই তাদের খেয়ে ফেলে। তারপর থেকে নাবিকেরা দ্বীপটি এড়িয়ে চলেন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৮৮০ সালে মরিস ভিডাল পোর্টম্যান নামের এক প্রশাসক দলবল নিয়ে ওই দ্বীপে নামেন। ব্রিটিশ শাসকদের তখন লক্ষ্য ছিল, জারোয়া-ওঙ্গি-সেন্টিনেলদের কাউকে কিডন্যাপ করে তাকে কিছুটা ‘সভ্য’ করে আবার আদিবাসীদের কাছে ফেরত পাঠানো। সেই দলের এক অভিযাত্রী বর্ণনা করেছিলেন, ‘আমরা বুঝতে পারতাম কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেতাম না। ঠিক যেন ঝোপের আড়াল থেকে বাঘের নজর রাখা!’ দিন কয়েক খালি হাতে অপেক্ষার পর এক বৃদ্ধ দম্পতি আর চার শিশুর দেখা পান পোর্টম্যান, যারা দৌড়ে পালাতে পারেনি। তাদের কিডন্যাপ করে পোর্টম্যান সগর্বে পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরলেও রোগব্যাধির হাত থেকে দম্পতিকে বাঁচানো যায়নি।

এরপর ১৯৬৭ সালে টিএন পণ্ডিত নামে এক নৃতাত্ত্বিকের নেতৃত্বে প্রবালপ্রাচীরে দ্বীপটিতে অভিযাত্রী দল পাঠিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু কোনও সেন্টিনেলের দেখা পায়নি তারা। ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি দল তথ্যচিত্র তুলতে ওই দ্বীপে পৌঁছয়। তারা যখন সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন পরিচালকের উরু ফুঁড়ে দেয় অতর্কিতে ছুটে আসা তিরের ফলা। জিওগ্রাফিকের দলটি সত্রাসে দেখে, শত্রুকে ফুঁড়ে দেওয়ার উল্লাসে ফেটে পড়েছে এক আদিম অরণ্যচর। ১৯৮১ সালে ওই দ্বীপের বালুচরে আটকে পড়া প্রিমরোজ নামে হংকংয়ের একটি জাহাজের নাবিকরা দেখা পেয়েছিলেন সেন্টিনেলদের। তবে তাদের ভাগ্য ভালো, বিষাক্ত তিরে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়ার আগেই তাদের উদ্ধার করা হয়।

এরপর সেন্টিনেলদের সঙ্গে ভারতের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টায় বিফল হয়। ২০০৪ সালে ভয়াবহ সুনামির পর ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের খোঁজ করতে গেলে হেলিকপ্টারের দিকে তীর ধনুক নিক্ষেপ করে তারা। অনেকবার চেষ্টার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।

ভারত মহাসাগরের বুকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাস সেন্টিনেলদের। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ৫০ এর মধ্যে। তবে বহির্বিশ্ব থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। নিজেদের এলাকায় বাইরে কারও প্রবেশ একেবারেই পছন্দ নয় তাদের। কোনও মুদ্রা ব্যবহার করে না সেন্টিনেলরা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না সরকারও। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা তাদের এলাকায় প্রবেশ বেআইনি। ভিডিও ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড করাও নিষিদ্ধ।