• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চলবে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৮ জুলাই ২০২০  

দেশের ৩১ জেলা বন্যাকবলিত। বন্যার কারণে জেলাগুলোর প্রায় ৪৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩২ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে পানিবন্দি মানুষকে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে। কারণ ঢাকা মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, নাটোর বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ও নওগা জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আগামী কয়েকদিনে আরও অবনতি হতে পারে। এর পর হয়তো পানি নামতে শুরু করবে, তবে সমুদ্রে জোয়ার থাকলে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি নামতে বিলম্বিত হবে। যা চলবে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় দেশের বন্যাকবলিত ৩১ জেলার মধ্যে রয়েছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, ফেনী, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, লক্ষীপুর, নাটোর, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুর। এসব জেলার পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৪৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩২ জন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬০৯টি। বন্যাকবলিত ইউনিয়নের সংখ্যা ৮৯৯টি। আর এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে, নৌকা ডুবে মারা গেছেন ৩৫ জন।

পানি থেকে বাঁচতে বন্যাকবলিত মানুষ নিজের বাড়িতে ঘরের চালে, বা উঁচু মাচা করে, কেউ সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে, কেউ বেড়িবাঁধের ওপর, কেউ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, আবার কেউ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। সরকারি ত্রাণ বিতরণ চলছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সোমবার ২৭ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ দেশের বন্যা কবলিত জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এক হাজার ৫৯২টি। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৮৮ হাজার ২৩৩ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৩৬ হাজার ৪৯৭ জন, নারী ৩২ হাজার ৯৯৮ জন। শিশুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৪৭৬ জন ও প্রতিবন্ধী ২৭২ জন।

এদিকে চলমান বন্যা মোকাবিলায় দুর্গত মানুষদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কোভিড ও বন্যা যেহেতু একসঙ্গে এসেছে, এ কারণেই একটু বেশি কেয়ারফুল থাকতে হবে। সব মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাঠেই থাকবেন, মানুষের পাশে থাকবেন। এসময় বন্যায় আমনের ক্ষতি হলেও পলির কারণে বন্যার পরের সুফল নিতে কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারদের নির্দেশনা দেন তিনি।
 
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে বন্যা কবলিত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নেই, সেখানকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় মানুষজন যাতে আশ্রয় নিতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে জানা গেছে, এখনও বন্যা কবলিত চার জেলায় কোনও আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়নি। অন্যদিকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বেশ কয়েকটি জেলায় খোলা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দুর্গত লোকজন বাড়ি চলে গেছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজেস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী ও ও গাজীপুর জেলায় কোনও আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এর মধ্যে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট সদর, আদিতমারি ও পাটগ্রাম উপজেলায় পানিবন্দি ৩৯ হাজার ৫৪৮টি পরিবারের মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৭৭ হাজার ৯৬৬ জন।

 রংপুর জেলায় গংগাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৮ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার সদস্য। টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতি, টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলায় পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ২২ হাজার ৪০০। এসব পরিবারের এক লাখ ৪৫ হাজার ৩০৪ জন সদস্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তবে রাজবাড়ি জেলায় এখনও পর্যন্ত বন্যার উদ্ভব হয়নি বলে আশ্রয়কেন্দ্র খোলার প্রয়োজন হয়নি। যেহেতু এ জেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী, সেহেতু বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় এ জেলা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

এছাড়াও মানিকগঞ্জ জেলায় ১০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে তা বন্যা কবলিত মানুষের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এ জেলায় এখনও পর্যন্ত বন্যা কবলিত মানুষের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার ৯৬ জন। পরিবারের সংখ্যা ৬৮৮টি।

 অপরদিকে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করায় নেত্রকোনা ও নওগাঁ জেলায় খোলা আশ্রয় কেন্দ্র থেকে মানুষজন বাড়ি চলে গেছে। ফেনীতে এখনও বন্যার উদ্ভব হয়নি বিধায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলার প্রয়োজন পড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা। নেত্রকোনা জেলায় বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো হচ্ছে দূর্গাপুর, কলমাকান্দা, খালিয়াজুড়ি, বারহাট্টা ও মদন। এসব উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের আট হাজার ৬০০ পরিবারের ৬৪ হাজার ১০০ মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

 এনডিআরসিসি সূত্র জানায়, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ৭৪ হাজার ৬৯৭টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ৪১ হাজার ২৭৪টি। ছাগল ও ভেড়া ২৪ হাজার ৩৪৮টি। এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশু ৯ হাজার ৭৫টি। এ সব জেলার মাছের ঘেরের মাছ ভেসে গেছে, সবজি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। তবে এর হিসাব এখনও করা সম্ভব হয়নি। বন্যার পানি নামতে শুরু করলে এসব ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে।

বন্যাকবলিত জেলায় জরুরি সেবার জন্য ৯৩৬টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হলেও বর্তমানে ৪১৮টি টিম কাজ করছে।

 আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, অতিবৃষ্টিজনিত উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল বন্যার কারণ। এতে দেশের শাখাপ্রশাখাসহ ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০০ নদনদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। জুলাই মাসে আরও বৃষ্টিপাত হবে। এ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতও হবে। তবে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। তবে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দিতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যবহারের জন্য বিশেষ নৌযান বা উদ্ধারকারী বোট প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড যৌথভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে আগামী ৩ বছরে ৬০টি নৌযান সরবরাহ করবে। প্রতিটি বোটে প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, একটি হুইল চেয়ার, একটি স্ট্রেচার এবং একটি ওয়াকিটকি থাকবে। প্রতিটি বোটে ৮০ জন যাত্রী ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি বহন করা যাবে।
 
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য ৬টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে আগামী ২১ দিনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ সময় কমিটিগুলো উপজেলা, ইউনিয়ন গ্রাম পর্যায়ের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম তদারকি করবে বলে জানান তিনি।