• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মানিকগঞ্জের ডাক্তারদের `ঢাকায় থাকা রোগ`

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

মানিকগঞ্জের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে ঢাকায় থাকার প্রবণতা প্রবল। বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারদের অধিকাংশ হয় ঢাকা, না হয় জেলা সদরে থাকেন। যে কারণে সময়মতো কর্মস্থলে উপস্থিতির হার শূন্য বললেই চলে। সকাল ১০টার আগে চিকিৎসকদের দেখা মেলে না। আবার বাসা দূরে হওয়ায় দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়েন। গত ২৮ জানুয়ারি সোমবার দৌলতপুর ও সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন এ অবস্থা দেখা গেছে। রোগী ও তাদের স্বজন এবং স্থানীয় লোকজন জানান, চিকিৎসকরা উপজেলাতেই থাকেন না। বেশিরভাগ ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করেন। এটি চিকিৎসকদের এক ধরনের 'রোগ' হয়ে গেছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে স্থানীয় মানুষদের। চিকিৎসক না থাকায় কোনো কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় না রোগী। তবে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর চিত্র বদলেছে সদর হাসপাতালের।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নিজ জেলা মানিকগঞ্জ। ফলে প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে এ জেলার মানুষের আশা অনেক বড়। কিছু উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চলছে সেই আগের মতোই। অনিয়মকেই এখানকার চিকিৎসকরা নিয়ম করে ফেলেছেন। দেরিতে আসাই তাদের রেওয়াজ। ঠিকমতো ডাক্তার পাওয়া যায় না, তাই রোগীরাও সহজে ভর্তি হয় না। কখনও কখনও ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে ভর্তি রোগীই পাওয়া যায় না। দুপুর ১২টার পর চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া দুরূহ। এর সঙ্গে আছে প্রেষণ ও ছুটির বাড়াবাড়ি।

দৌলতপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ১৮টি পদের ছয়টি শূন্য। বাকি ১২ জনের পাঁচজন চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছেন। দু'জন প্রশিক্ষণে। একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। আরেকজন স্ত্রীর অস্ত্রোপচারের জন্য ছুটি নিয়েছেন। আরেকজন ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য ছুটিতে। যে কারণে বর্তমানে ১২ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১০ জনই ছুটিতে। দু'জন ডাক্তারের মধ্যে একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। নানা প্রশাসনিক কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন। অন্যজন মেডিকেল অফিসার।

সম্প্রতি ৫০ শয্যার দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন গিয়ে  সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত একজন চিকিৎসককেও পাওয়া যায়নি। আগের রাতে নাইট ডিউটি করেন মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে প্রেষণে থাকা ডা. সোলায়মান হোসেন। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে তিনিই সকাল সাড়ে ৯টায় আবার হাসপাতালে আসেন।

ডা. সোলায়মান জানান, তিনি প্রেষণে থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. জুবাইদা নাসরীন তাকে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটি করতে বলেন। পরের দিন সকাল ৮টায় ডা. নুসরাত ফাতেমার আসার কথা ছিল। ডা. নুসরাত ঢাকায় থাকেন। তার আসতে দেরি হওয়ায় তিনিই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। টিএইচও কোথায় জানতে চাইলে ডা. সোলায়মান বলেন, তিনি আসছেন

সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালে আসেন ইউএইচএফপিও জুবাইদা নাসরীন। তিনি জানান, হাসপাতালে আসার আগে তিনি একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ১৮ জন চিকিৎসকের প্রয়োজন। এখানে পদায়ন আছে ১২ জনের। এর মধ্যে প্রেষণে রয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন- পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ডা. সোলায়মান হোসেন, মানিকগঞ্জ ২০৫ শয্যা হাসপাতালে ডা. শাহরীন গীতি, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজে ডা. থোয়াই অং চিং মারমা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. রইস উজ জামান ও সাভার ইউএইচসিতে ডা. সৈয়দা সামিউন নাহার। আর পাঁচজন বিভিন্ন কারণে ছুটিতে আছেন। এ অবস্থায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে আসেন ডা. নুসরাত ফাতেমা। তার আসার কথা ছিল সকাল ৮টায়। দেরিতে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকায় থাকেন। তাই আসতে দেরি হয়েছে।

হাসপাতালের কয়েকজন নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে কোনো ডাক্তার থাকেন না। যে দিন যে ডাক্তারের নাইট ডিউটি পড়ে তিনিই শুধু রাতে দৌলতপুর থাকেন। বাকিরা সকাল ১০টার আগে আসেন না। আবার ১২টা বাজতে না বাজতেই চলে যান।

দুপুর ১টার দিকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নারী ওয়ার্ডে কোনো রোগী নেই। তবে রেজিস্টার খাতায় তিনজনকে ভর্তি দেখানো হয়েছে। কর্তব্যরত নার্স ফাতেমা জানান, সকালবেলায়ও তিনজন রোগী ছিল। ১২টার পর তারা চলে গেছে। তাও যদি হয়, তাহলে ওই দিন এই ওয়ার্ডে আর কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, রেজিস্টার খাতায় ভর্তি রোগী ১০ জন। তবে পাওয়া গেল ছয়জনকে। বাকি চারজন কোথায় জানতে চাইলে নার্সরা বলতে পারেননি। তারা জানান, হয়তো রোগীরা বাইরে গেছেন। কিন্তু চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া কোনো রোগীর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। দুই ওয়ার্ডের এমন করুণ চিত্র হলেও রেজিস্টারে প্রতিটি ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী দিনে আটজন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোকন জানান, তিনি রাতে ভর্তি হয়েছেন। রাতে কোনো ডাক্তার আসেননি। সকাল ১১টার দিকে একজন ডাক্তার এসেছিলেন।

পেট ব্যাথা নিয়ে গত দেড় মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন মতিউর রহমান। তিনি জানান, কখনও কখনও ডাক্তার আসেনএভাবেই চলে সব সময়।

সরেজমিনে সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১ জন ডাক্তারের মধ্যে পাওয়া গেল মাত্র দু'জনকে। একজন হলেন ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. স্বপন কুমার সুর। তিনি একাই নাইট করে সকালেও রোগী দেখছিলেন। দেখা গেল আরেকটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। একাধিক চিকিৎসকের চেম্বারে রোগী দেখছিলেন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল সহকারীরা। আর গাইনি বিভাগের ডা. নিসপুন্নাহারের সকাল ৮টায় হাসপাতালে আসার কথা থাকলেও তিনি আসেন ১০টার পর। কারণ তিনিও ঢাকায় থাকেন।

ডা. স্বপন কুমার সুর জানান, ৫০ শয্যার সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১ জন চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন। তারা প্রতিমাসে বেতন নিচ্ছেন। এর মধ্যে ১০ জন প্রেষণে আছেন। দু'জন নারী চিকিৎসক মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। তিনি আরও জানান, ডা. নিসপুন্নাহার ১০টার পর এসেছেন। শিশু কনসালট্যান্ট ডা. গোলাম সাদিক ও মেডিসিন বিভাগের ডা. নুরুল ইসলাম সপ্তাহে দু-তিন দিন আসেন। এভাবে একটি হাসপাতাল চলতে পারে না।

এদিকে, হাসপাতালে হোমিও চিকিৎসকের পদে কর্মরত ডা. ইসরাত জাহান রিতু সকাল থেকে সাটুরিয়ার একটি ক্লিনিকে রোগী দেখে হাসপাতালে ঢোকেন বেলা সাড়ে ১১টায়। আসতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, কার অনুমতি নিয়ে সাংবাদিক হাসপাতালে এসেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. রিতু প্রতিদিনই দেরিতে আসেন। তিনি সাটুরিয়ায় বিসমিল্লাহ ক্লিনিকের একজন শেয়ারহোল্ডার। অথচ রোগীদের বলছেন, চিকিৎসক না পেয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।

এ ব্যাপারে সাটুরিয়া স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এনামুল কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, ঢাকায় একটি জরুরি মিটিংয়ে আছেন তিনি।

চিত্র বদলেছে মানিকগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের :গত দু'দিন ধরে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসাপতালে কর্মরত চিকিৎসকরা সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন। এখানকার ৪০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৩ জনই ঢাকা থেকে আসেন। তাদেরই অধিকাংশই সকাল ৮টায় কর্মস্থলে আসতে পারতেন না। গড়ে দুই ঘণ্টা কর্মস্থলে দেরিতে আসতেন তারা। তবে কর্মস্থলে না পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ওএসডি করার যে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর থেকেই সময়মতো উপস্থিত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) লুৎফর রহমান জানান, ১০০ শয্যা হাসপাতালের জনবল নিয়ে ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সেবা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী মিলিয়ে এখনও ৭৮টি পদ শূন্য রয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, আগে চিকিৎসকরা কর্মস্থলে আসতে কিছুটা দেরি করতেন। তবে একজন চিকিৎসক দুই বছরের বেশি সময় ধরে অনুপস্থিত। জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চক্ষু) ডা. শেখ মাহমুদুর রহমান ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর যোগদান করলেও আজ পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে আসেননি।