• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

এসএসসি পর্যন্ত ঝরছে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৭ জানুয়ারি ২০১৯  

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি বাড়ির দারোয়ান ফয়জুল ইসলাম। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এরপর একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও তা ভাগ্যে কুলোয়নি।

জীবিকার তাগিদে সে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে ওই বাড়িতে ৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেয়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও ফয়জুলের ক্ষেত্রে তা অধরাই রয়ে গেছে।শুধু ফয়জুলই নয়, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০ বছরে প্রায় ৫৫ ভাগ শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩২ ভাগ প্রথম পাঁচ বছরে বা পঞ্চম শ্রেণীতে এবং বাকিরা পরের পাঁচ বছরে বা দশম শ্রেণী পর্যন্ত ঝরে যায়।

অথচ শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসা ও ধরে রাখার লক্ষ্যে সরকার বহু কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। বিনা মূল্যে বই দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে স্কুলে তাদের ধরে রাখার পেছনে ‘উপবৃত্তি’ দেয়ার নামে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের শতভাগ শিক্ষার্থীই এসেছে এই উপবৃত্তির কর্মসূচির অধীনে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুপুরে খাবার দেয়ার কর্মসূচিও আছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, এরপরও ১০ বছরে ৫৫ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে কেন?

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নানা সমীক্ষায় প্রমাণিত যে বর্তমানে শিক্ষা ব্যয় অনেক বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হলেও তা নিখরচায় নয়। মাধ্যমিক স্তরে অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয় অনেক বেড়েছে। পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) এবং জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার কারণে কোচিং বাণিজ্য ও নোট-গাইডের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। স্কুলগুলোতেও আরও অনেক ব্যয় আছে। এ কারণে দরিদ্র এবং কম আয়ের মানুষের শিক্ষার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোচ্ছে না। এককথায় বর্ধিত শিক্ষা ব্যয় মেটাতে না পারাই ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা, শিক্ষার ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ সন্তানকে লেখাপড়া করাতে চায়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবারে এসএসসি ও সমমান পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ শিক্ষার্থী। ২০০৮ সালে এসব শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। ওই বছর তাদের সঙ্গে প্রথম শ্রেণীতে সারা দেশে শিক্ষার্থী ছিল ৩৫ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ জন। এই হিসাবে দশ বছরে ঝরে পড়ার হার দাঁড়ায় ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

দশ বছরে ঝরে পড়ার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, ২০০৮ সালের প্রথম শ্রেণীর ওই ব্যাচটি ২০১২ সালে পঞ্চম শ্রেণীর পিইসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ওই বছর ২৪ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ জন অংশ নেয়। পাস করে ২৪ লাখ ১৫ হাজার ৩৪১ জন। এই ব্যাচটি থেকেই ২০১৫ সালে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৯৯ জন জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৭৭০ জন।

যদিও সরকারি তথ্য-উপাত্তে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে ভিন্নচিত্র আছে। ২০০৮ সালের ভর্তি এবং ২০১২ সালে পিইসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর পরিসংখ্যানে যেখানে ঝরে পড়ার হার দাঁড়ায় প্রায় ৩০ শতাংশ, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ২৬ শতাংশ। অপরদিকে সর্বশেষ প্রকাশিত ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৩৮ শতাংশ। অথচ উল্লিখিত পরিসংখ্যানে এটা দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ শতাংশ।

২০১৪ সালে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ঝরে পড়া প্রসঙ্গে বলেছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে দরিদ্র ও অ-দরিদ্রদের মধ্যে এখনও বড় ফারাক রয়েছে। এখন বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষায় দরিদ্রদের অবস্থান অ-দরিদ্রদের চেয়ে ৩১ ভাগ নিচে। তবে প্রাথমিক স্তরে এই অর্জন কিছুটা হলেও নজর কেড়েছে। কিন্তু বিশেষ করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ফারাক ব্যাপক। এতে স্কুলগুলোতে ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য এবং ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

বিশ্বব্যাংক ওই বাংলাদেশের শিক্ষার সঙ্গে দেশের শ্রমশক্তির সম্পর্ক এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে। এ প্রসঙ্গে এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখ শ্রমিক নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৮৮ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এরা মূলত ফয়জুলের মতো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটিতে আরও বলেছে, স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত শিক্ষার্থী মূলত দরিদ্রতার কারণেই স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কিছুদিন আগে গণসাক্ষরতা অভিযান (ক্যাম্পেইন) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যয়, কোচিং প্রবণতা ইত্যাদির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৯০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী কোচিং-প্রাইভেট পড়ছে। আর ইউনেস্কোর ২০১৭ সালের ‘দ্য কালচার অব টেস্টিং: সোসিওকালচারাল ইমপ্যাক্টস অন লার্নিং ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীই প্রাইভেট টিউশন গ্রহণ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেখাপড়ার স্রোতধারায় শিক্ষার্থীদের পরবর্তী পর্যায়ে ধরে রাখতে না পারার অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যক্তিগত খরচে লেখাপড়া শিখতে হচ্ছে। কিন্তু অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। রোববার ঢাকায় চানখারপুল এলাকায় কথা হয় আল মাহদী নামে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রের সঙ্গে। সে জানায়, প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়েই তাকে প্রাইভেট পড়তে হয়। ওই খরচ বহন করা তার বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে তাকে এখন হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করার চিন্তাভাবনা করছেন তার বাবা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে মোটা দাগে ছেলেদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিু আয় ও দারিদ্র্যই অন্যতম কারণ হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে আছে বাল্যবিয়ে। এ বিষয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বর্তমানে শুধু উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। কারণ কোচিং-প্রাইভেটসহ অন্যান্য খরচ অনেক বেশি। এ ছাড়া সামাজিক ও আর্থিক বাস্তবতার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এর মধ্যে ছাত্রীদের যাতায়াতে নিরাপত্তা অন্যতম।

ঝরে পড়ার বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ঝরে পড়ার ঘটনা উন্নত বিশ্বেরও বাস্তবতা। এই হার দেশে আগের চেয়ে অনেক কমেছে। তবে, দারিদ্র্যসহ অন্যান্য বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। আর প্রায় দু’বছর আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ঝরে পড়ার হারে গোমর আছে। উপবৃত্তি, স্কুলফিডিংসহ নানা কারণে এ ক্ষেত্রে গোঁজামিলের ব্যাপার আছে। আমরা সেই গোমর বের করে ছাড়ব। তবে এতদিনেও মন্ত্রণালয় কোনো গোমর প্রকাশ করতে পারেনি।