• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

শীতলক্ষ্যায় ভেসে উঠছে মাছ, দূষণ বন্ধে নেই উদ্যোগ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০২১  

শান্ত ও স্বচ্ছ জলের শীতলক্ষ্যার সেই রূপ আর নেই। গত কয়েক বছরে দূষণে সে তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। এখন বিপন্ন জলজ প্রাণীগুলোও। গত কয়েকদিন ধরে শীতলক্ষ্যার বুকে হঠাৎ ভেসে উঠছে মাছসহ জলজপ্রাণী। এ খবরে স্থানীয়দের মধ্যে মাছ সংগ্রহের উৎসব শুরু হয়েছে। সেই মাছ কিংবা নদীর পরিবেশ রক্ষায় নেই কোনো উদ্যোগ। তবে, পরিবেশবাদীসহ সচেতন মহল বলছে, ঐতিহ্যবাহী এই নদীকে কল-কারখানার দূষণ থেকে বাঁচাতে অনতিবিলম্বে  উদ্যোগ নিতে হবে।

গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী, কাপাসিয়ার সিংহশ্রী, কালীগঞ্জের মোক্তারপুর, জামালপুর ও বাহাদুরসাদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয়দের মধ্যে দেশি মাছ ধ্বংসের এই চিত্রে হতাশাও তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা জানান,  এ নদী ঘিরেই এলাকার কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য ও গ্রামীণ অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে।

দেশি মাছের অন্যতম ভাণ্ডার ছিল এই শীতলক্ষ্যা। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে শিল্পকারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ‌্যে শীতলক্ষ্যা দূষিত হচ্ছে।  এতে স্বচ্ছ জলের পরিবর্তে কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে পড়েছে শীতলক্ষ্যা।

জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎস ছিল এই নদী। এই নদীকে ঘিরে স্থানীয় সহাস্রাধিক জেলে পরিবার জীবিকা চালাতো। সরকারি হিসাবে এই নদীর গাজীপুর অংশ থেকে প্রতিবছর ৫০০ মেট্রিক টন মাছের সরবরাহ পাওয়া যেতো।

শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের মানুষ আলতাফ হোসেন আলতু (৬৫)। তিনি বলেন, ‘ছোট থেকে বড় হয়েছি এই নদী পাড়ে। আমার জীবনে এই শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সবচেয়ে বড় মাছ ধরার অভিজ্ঞতা আছে। এমন কোনো দিন বাদ যায়নি, যে দিনে ২/৪টা বড় মাছ ধরিনি। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই বাস্তব দৃশ্য এখন কল্পনা। এখনকার ছেলে-মেয়েদের কাছে এগুলো রূপকথার গল্প মনে হবে। আমার বয়স হয়েছে এখন আর নদীতে মাছ শিকার করতে যাই না। আর যাবোই কিভাবে, নদীতে তো এখন আর মাছ নাই। স্থানীয় অনেক জেলে এখন পেশা বদল করে অন্য পেশার চলে গেছে। স্থানীয় কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে শীতলক্ষ্যা শেষ। যতটুকু আছে, সেটা কাল বিলম্ব না করে দ্রুত বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’  

বরমী খেয়াঘাটের মাঝি পরশ বলেন, ‘গত কয়েক বছরের মতো এবারও  শ্রীপুরের বরমী, কাপাসিয়ার সিংহশ্রী, কালীগঞ্জের মোক্তারপুর, জামালপুর ও বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মাছ ভেসে উঠছে। প্রচুর মানুষ নদী থেকে ভেসে ওঠা এসব মাছ সংগ্রহ করছে।’

স্থানীয় জেলে হরিপদ দাস জানান, শীতলক্ষ্যার মাছের ওপর ভরসা করে বংশ পরম্পরায় মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে শিল্প-কারখানার বর্জ্যের কারণে গত কয়েক বছর ধরেই এ নদীতে মাছের উৎপাদন অনেক কমেছে। এখন আর নদীতে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। বছরের এই সময়ে কয়েকটি দিন মাছ মরে ভেসে ওঠে। এভাবেই মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা। যে নদীকে কেন্দ্র করে একদিন তারা বেঁচে ছিলেন, চোখের সামনেই সেই নদীর মৃত্যু দেখতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নদীতে মাছ ধরছিলেন কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ভাদার্ত্তী গ্রামের কর্মজীবী শহিদুল, নুরুল ইসলাম, মাসুম এবং কাপাসিয়ার হাড়িয়াদি গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী তারিফুল ইসলাম। তারা জানান, গত কয়েকদিন থেকে মাছ যেন আর নদীতে থাকতে পারছিল না। নদীর তীরে লাফিয়ে ডাঙায় উঠছিল মাছগুলো। অনেক মাছ মরে ভেছে উঠছে। চিংড়ি, বাইম, বেলেসহ নানা ধরনের মাছ তারা সংগ্রহ করছেন। এভাবে মাছ ধরতে পারায় খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে শঙ্কাও রয়েছে, এভাবে যদি সব মাছ একসঙ্গে চলে যায়, তাহলে কি আর ভবিষ্যতে মাছ পাওয়া যাবে?

হঠাৎ করে শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ ভেসে ওঠার বিষয়ে নদী গবেষক, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনিন হোসেন বলেন, ‘এ সময়টাতে নদীতে পানি কমে যায়, সঙ্গে শিল্প কারখানার বর্জ্যও নদীকে বিষাক্ত করে তোলে। নদীর পানিতে অক্সিজেন সংকট তৈরি হয়। ফলে মাছসহ জলচর প্রাণীগুলো বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ হারায়। এ কারণে ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন ঘোষণা না হলেও শীতলক্ষ্যাও একই পরিস্থিতির শিকার হবে।’

মো. মনিন হোসেন আরও  বলেন, ‘নদী কথা বলতে পারে না। নদী পক্ষে আমাদেরই কথা বলতে হবে। তাছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই নদী ও নদীর জীববৈচিত্র‌্য রক্ষা করতে হবে। এজন্য দ্রুত শিল্প কারখানার দূষণ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।’

গাজীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিল্পকারখানার দূষণে বর্তমানে শীতলক্ষ্যা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। স্থানীয় বিভিন্ন শিল্পবর্জ্য এর জন্য দায়ী। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মাছের দুর্দশা দেখেছি। এভাবে চলতে থাকলে শীতলক্ষ্যার সব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’