• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

সরকারের অর্জন, খাদ্যঘাটতি থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় বাংলাদেশ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারি ২০২১  

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম যে সংকটটি দেখা দেয়, সেটি হলো খাদ্য সংকট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই সংকট অবশ্য প্রথম বছরেই কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ। পরে কয়েকটি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় আবারও পথ হারায় বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষেরা খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকেও হয় বঞ্চিত। ১৯৭৫ সালের পর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠে যে, সমাজের অল্প আয়ের মানুষেরা এক বাটি ভাতের মাড়ের জন্য অর্থবানদের দরজায় ধরনা দিতো। যা বর্তমানে এসে মনে হবে রূপকথা!

১৯৯৬ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ প্রথমেই অভাব নামের এই ‘রূপকথা’কে দেশ থেকে বিদায় করতে কাজ শুরু করে। জোর দেয়া হয় খাদ্য নিরাপত্তার দিকে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন শেখ হাসিনার সরকার। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারে সেই স্বপ্ন আবারও ধাক্কা খায়। ফলে ২০০৯ সালে পুরনো এই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে আসে নতুন রূপে। এর পরের ১২ বছরে এই চ্যালেঞ্জ বেশ ভালোভাবেই উতরে যায় শেখ হাসিনার সরকার। ফলে বাংলাদেশ আবারও হয়ে উঠে খাদ্যে-বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক দেশ।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে জানা যায়, স্বাধীনতার পর দেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রবর্তন করা হয় উফশী জাত আইআর-৮। সে সময় ব্রি’র বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেন তিন মৌসুমে চাষ উপযোগী উচ্চফলনশীল ধানের আধুনিক জাত বিআর-৩। এটি বিপ্লব ধান নামেও পরিচিত। এসব বীজের উদ্ভাবনের মাধ্যমে মান্ধাতার আমলের কৃষি থেকে বের হয়ে দেশে আধুনিক চাষের গোড়াপত্তন হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে আবারও প্রাণ ফিরে পায় দেশের কৃষি। শুরু হয় খাদ্য উৎপাদনে সবুজ বিপ্লব। ফলে ১৯৯৯ সালে এসে দেশ প্রথমবারের মতো অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এজন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদকও পান শেখ হাসিনা।

২০০৯ সালে ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতিসহ সরকার পরিচালনা শুরু করে শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালে এসে আবারও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। সে বছর খাদ্য উদ্বৃত্তও হয়। এর পরের বছর থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত চাল বিদেশেও রফতানি শুরু হয়। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যায়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয় প্রথম।

করোনা ঝুঁকির সময়েও ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে দেশে। যেখানে পুরো বিশ্ব জর্জরিত খাদ্য সংকটে। বিগত আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে আশাতীত বাম্পার ফলন হয়েছে। দশক বিবেচনায় ২০১০-১৯ পর্যন্ত ৬ লাখ মেট্রিক টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা এই দশকেও অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন বলেন, খাদ্য কিনতে এক সময় বাংলাদেশকে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হতো। আয়ের বেশি অংশ ব্যয় হতো খাদ্য আমদানিতে। বর্তমান সরকার কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়ায় দেশিয় আয় থেকে খাদ্য না কিনে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে বাংলাদেশ। এটি নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমরা যদি একটু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি তাহলে বুঝতে পারবো দেশকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। আমরা যেখানে চাল কিনে ব্যয় করতাম, সেখানে চালের আয়ে এখন দেশে বড় বড় উন্নয়ন হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে দ্রুতই দেশ উন্নত দেশের কাতারে চলে যাবে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, দেশের মানুষকে এখন আর খাবারের অভাবে খালি পেটে ঘুমাতে যেতে হয় না। প্রত্যেক বছর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে বাংলাদেশ। এখন উদ্বৃত্তও হচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির আমলে এসব কিছু ছিল স্বপ্নের মতো। আমরা কৃষি বিপ্লবের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। দেশের মানুষের সামনে অভাব যেন আর কখনও দাঁড়াতে না পারে শেখ হাসিনা সরকার সেই ব্যবস্থাই করে যাচ্ছেন।   

এক নজরে কৃষিখাতে উন্নয়ন:

খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান এখন দশম। এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চল বিশেষে প্রায় চার ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে এবং দেশে বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ।

সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে সরকার। ২০১৮ সালে সার খাতে ৫৮ হাজার ৯ শত ৪৫ কোটি টাকা আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে।

২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে কৃষি প্রণোদনা/পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ জন কৃষক উপকৃত হয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডও প্রদান করেছে সরকার।

১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২ শত ৮২ কোটি টাকা।

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ (এ বছর তৃতীয় হতে যাচ্ছে)। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ, ধানসহ এ পর্যন্ত ধানের ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৮৮ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে।

কৃষি পণ্য রফতানি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭৩ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে ধান, গম, পাট, ভূট্টা, আলু, সবজি, তৈল ও মসলাসহ বিভিন্ন ফসলের গুণগত মানসম্মত বীজ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮ শত ৭৪ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৯ শত ২২ মেট্রিক টনে।

২৮ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি আলুবীজ হিমাগার নির্মাণ এবং ৪টি টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ১৪ হাজার ৫ শত ২০ দশমিক ৪২ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য ধারণ ক্ষমতা ২০২১ সালের মধ্যে ৩০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বর্তমানে ৬ দশমিক ৪০ লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার আধুনিক খাদ্য গুদাম/সাইলো নির্মাণের লক্ষ্যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

দেশের উত্তরাঞ্চলে ১ দশমিক ১০ লাখ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন খাদ্যগুদাম নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলে মোট ১৪০টি গুদামসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

সারাদেশে ১০০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ৭০টি গুদাম এবং ৫০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষম ১৩০টি গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে।

মোংলা বন্দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন কনক্রিট গ্রেইন সাইলো, আনলোডার, সাইলো জেটি নির্মাণ, সাইলো ভবনসহ বিভিন্ন ধরনের কনভেয়িং সিস্টেম ও ওজন যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।

বগুড়া জেলার সান্তাহার সাইলো ক্যাম্পাসে বহুতল গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। সোলার প্লান্টসহ ২৫,০০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার মাল্টিস্টোরিড ওয়্যারহাউজ নির্মাণকাজ সমাপ্ত করা হয়েছে।

ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর ইত্যাদি খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়েছে।

ভিজিডি খাতে পুষ্টি চাল বিতরণ; হাওর এলাকায় ১০০ দিন কর্মসূচিতে ১০ টাকা মূল্যে চাল বিতরণ ও ওএমএস কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

২০১৫ সালে শ্রীলংকায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন চাল রফতানি করা হয়েছে।

২০১৬ সালে নেপালে ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল সাহায্য হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।

২০১৬ সাল হতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি করে প্রতি বছর ৫ মাস (সেপ্টেম্বর, নভেম্বর ও মার্চ-এপ্রিল) চাল ১০ টাকা কেজিতে বিতরণের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলমান রয়েছে।