• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

হারিয়ে যেতে বসেছে তালগাছ, দেখা মেলে না চিরচেনা রূপের

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০  

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে,উঁকি মারে আকাশে। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা পড়েন নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিলই বটে। মেঠো পথের দুইধারে সারি সারি তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি আমাদের গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপ। আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি তালগাছ সেই আদিকাল থেকেই গ্রামবাংলার শোভা বাড়িয়ে এসেছে। আর তালগাছের পাতায় বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা বাতাসে দুলে দুলে গভীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। 

তবে ইট পাথর আর সুড়কির রাস্তায় হারিয়ে গেছে সেই চিরচেনা রূপ। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে রক্ষায় এবং শোভা সৃষ্টিতে তালগাছের জুড়ি মেলা ভার। তালগাছ শুধু শোভা ছড়িয়েই বসে থাকেনি। এর পাশাপাশি নিজেকে পুরোটাই বিলিয়ে দিয়েছে মানুষের নানা কাজে। তবে এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না তাল গাছের সারি। শহরে তো এই দৃশ্য স্বপ্ন। তবে গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে পুরোপুরি। এতে বিলীন হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

তালগাছ যে শুধু প্রকৃতির রূপ বাড়িয়েছে তা কিন্তু নয়। এর সর্বত্র ব্যবহার করেছে মানুষ বিভিন্ন কাজে। চিরসবুজ বাংলাকে বুক পেতে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছে তালগাছ। মাঝে মাঝেই হয়তো বিভিন্ন সরকারি সতর্কবার্তায় শুনে থাকবেন, বাড়ির আনাচে কানাচে তালগাছ লাগাতে বলা হয়। কেন জানেন কি? তালগাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। দেশে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার কমানোতে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে তালগাছ। এছাড়াও তালগাছ এর বিভিন্ন অংশ জীবনের নানাবিধ চাহিদা মিটিয়ে এসেছে। যেমন- তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, পুতুল ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড দিয়ে ভেলা বা নৌকা, ঘরের খুঁটি বানানো হয়।

 

তাল গাছের রস সংগ্রহ করা হচ্ছে

তাল গাছের রস সংগ্রহ করা হচ্ছে

তাল হচ্ছে একটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন গাছ। এই গাছের ফলকেও তাল বলা হয়। এর আদিবাস মধ্য আফ্রিকা। তাল গাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৩০ ফুট পর্যন্ত পৌছতে পারে। এর জীবনকাল প্রায় ১০০-১৫০ বছর। তালগাছ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অন্যতম পরিবেশবান্ধব, জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী গাছ।   

এছাড়াও তালের রস, ফলের ব্যবহার তো রয়েছেই। তালের পিঠার কথা শুনলেই যেন জিভে জল এসে যায়। প্রাচীনকাল থেকেই তালগাছ তার রস, ফল, বীজের শাঁস দিয়ে ভোজনরসিক বাঙালির রসনাবিলাস করে আসছে। তালের রয়েছে নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাসিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ অনেক খনিজ উপাদান। এর সঙ্গে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি, তাড়ি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। 

তাল শাঁসের কথা ভুলে গেলে চলবে না। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে কাঁচা তাল ফলের শাঁস খাওয়ার জন্য চারিদিকে হাক-ডাক পড়ে যেত। চলতো শাঁস খাওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা। ইদানিং শহরে এই সময়টাতে তালের শাঁসের দেখা মেলে। বর্তমান প্রজন্ম এর স্বাদ আর মর্ম না বুঝলেও আগের প্রজন্মের অনেকেই হারিয়ে যান পুরনো স্মৃতিতে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তালগাছের তলায় গেলেই পাকা তালের সুবাসে মন জুড়িয়ে আসত। এমনকি ভাগ্যে থাকলে দুই-চারটি পাকা তালও পাওয়া যেত। গাছ থেকে ধুপ ধাপ শব্দে তাল পড়লে তা দূর থেকেই শোনা যেত। এই সময়টাতে পাকা তালের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো প্রতিটি বাড়ি।

 

তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা

তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা

বাড়ির ঝি-বউয়দের বেশ কসরত করে পাকা তালের আটি থেকে হলুদ রস বের করতো। এরপর সেই রস দুধ ও কোরানো নারকেলসহ জ্বাল দিয়ে ঘন করার পালা। এটি অনেক সময় এমনিতেই আবার অনেক সময় চিড়া-মুড়ি দিয়ে খাওয়া হতো। শ্রাবণ মাসে তালের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত গড়ে ঘরে। শুধু তালের ভাজা পিঠাই নয়, তালের রুটি, তালের চুসি,তালের বড়া ও তালসত্বসহ আরো কতো বাহারী রকম পিঠা! মেহমানদারীতে সেসব পিঠা ছিল স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। তাই এখনো তালের রস, শাঁস ও পিঠার কদর সারা বাংলাদেশেই আদি ও অকৃত্রিম।

একসময় গ্রামবাংলার অধিকাংশ বাড়ি, রাস্তা ও মাঠের প্রচুর তালগাছ দেখা যেত। তবে কালের পরিক্রমায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী তালগাছ। তবে এখন আর তেমন দেখা মেলে না তালগাছ। বাবুই পাখির বাসার হাজার হাজার বাবুই পাখির কিচির-মিচির ডাকের মনোরম দৃশ্যও চোখে পড়ে না আর। তাই বর্তমানে দূর থেকে ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ, খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের সেই দৃশ্য দেখা যায় না আর। এই দৃশ্য এখন কল্পনাতেই রয়ে গেছে।  

তবে পরিবেশ রক্ষার্থে আমাদেরবেশি করে তালগাছ রোপণ করা দরকার। ইদানীং আমাদের দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশ বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ কিন্তু তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। তাই পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষা এবং অন্যান্য উপকার পেতে তালগাছের চারা রোপণ ও সুরক্ষা করা ভীষণ জরুরি। বাড়ির আশেপাশের কালি জায়গাতে কয়েকটি তালের বীজ পুতে দিতে পারেন কিংবা রাস্তার ধারে। কোনো রকম যত্ন ছাড়াই তালগাছ বড় হতে পারে। নিজেদের স্বার্থেই এটি করতে পারেন। তবে তালগাছ কোনো স্বার্থ ছাড়াই আপনার প্রয়োজন মেটাবে।