• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

চরাঞ্চলের আতঙ্ক রাসেলস ভাইপার

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৯ জুন ২০২৪  

‘আমরা চরাঞ্চলের মানুষ। আমাদের প্রধান কাজ জমিতে ফসল ফলানো আর গরু ছাগল পালন। চরের সবাই এই কাজের সঙ্গে জড়িত। শত শত বিঘা জমিতে ভুট্টা, বাদাম, তিল ও ধানের আবাদ করি আমরা। গত বছর থেকে চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপার সাপের উৎপাত বেড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন। বিষাক্ত এই সাপের ভয়ে খেতে ঠিকমতো কাজও করতে পারি না এখন। কাজ না করেও উপায় নাই। তাছাড়া, জীবন চলবো না।’ 

এই কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের কৃষক শেখ শমসের আলী। রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামে পরিচিত। হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ী ইউনিয়নের চরাঞ্চলে গত তিন মাসে বিষধর এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন পাঁচ জন। উপজেলার চরাঞ্চলগুলোতে সম্প্রতি এই সাপের উপদ্রব বাড়ায় আতঙ্কে রয়েছেন প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। কৃষক শেখ শমসের আলী বলেন, ‘গত সোমবার দুপুরে আজিমনগর ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে ধান কাটার সময় একটি সাপ দেখতে পাই। দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসি। পরে চার পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে সাপটিকে মেরে ফেলি। মারার পর জানতে পারি এটা বিষধর রাসেলস ভাইপার। 

গত বৃহস্পতিবার এক কৃষক খেত থেকে তিল কাটেন। দুপুরে সেই ফসল আনতে গেলে তিলের বোঝায় এই ধরনের সাপ দেখতে পান। একের পর এক এই সাপের দেখা মেলায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। যার জন্য খেত থেকে ফসল ও গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটতে যেতে ভয় পাচ্ছেন কৃষকরা।’ স্থানীয় আব্দুল বাতেন বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমাদের ইউনিয়নের পশ্চিমচর গ্রামের আজ্জেম নামের এক কৃষক এই সাপ দেখতে পান। তিনি দা দিয়ে কুপিয়ে সাপটিকে দুইভাগ করে ফেলেন। শিকারপুরের সাইদুল মোল্লা তার জমির ধানের আঁটি গাড়িতে তোলার সময় রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পান। কয়েকজন মিলে পরে সাপটিকে মেরে ফেলেন।’

লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে গত তিন মাসে অয়ন শীল, রুবেল বেপারী ও শেখ লাল মিয়ার মৃত্যু হয়েছে। ফরিদপুর জেলা সংলগ্ন পদ্মার চর এলাকায় এই সাপের উপদ্রব আছে। সেখানেও কয়েকজনকে এই সাপ কামড় দিয়েছে বলে শুনেছি।’ আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘রাসেলস ভাইপারের আনাগোনা আমাদের ইউনিয়নের এখন বেশি দেখা যাচ্ছে। ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় সবার মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। আমার ইউনিয়নেই দুই জন সাপের কামড়ে মারা গেছেন। যেখানে ধান ও ভুট্টার আবাদ করা হয়েছে সেখানে  ঝুঁকি বেশি। সচেতনতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করছি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, ‘বর্তমানে হরিরামপুরের চরাঞ্চলের জমিগুলোতে বছরে একাধিক ফসল আবাদ করেন কৃষকরা। খেতে ফসল থাকায় ইঁদুরের সংখ্যাও বাড়ছে। পর্যাপ্ত খাদ্য ও বংশবিস্তারের জন্য যথাযথ পরিবেশ থাকায় রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেড়েছে ওই চরাঞ্চলগুলোতে। আমরা সব সময়ই কৃষক ভাইদের সতর্কতার সঙ্গে খেতে কাজ করার অনুরোধ করছি।’ হরিরামপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকৃতি ও ধরন দেখে মনে হচ্ছে রাসেলস ভাইপার সাপটি উজানের কচুরিপানার সঙ্গে আসার সম্ভাবনা বেশি। পরে এই সাপ চরাঞ্চলে আবাস্থল গড়ে থাকতে পারে। উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।’

হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেহেরুবা পান্না বলেন, ‘হরিরামপুরের চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রবে বেড়েছে। বিষাক্ত সাপ কামড়ালে এন্টিভেনম দেওয়ার আগে বেশ আইসিইউ সাপোর্ট, ইন্টিভিশন (গলার মধ্যে নল দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা), কার্ডিয়াক মনিটরের মতো কিছু সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে। বিষাক্ত সাপ কামড়ালে রোগীর রক্ত ভেঙে ফেলা কিংবা নার্ভকে অবশ করে ফেলতে পারে। যখন এমন কন্ডিশনে রোগী চলে যায় তখন ইন্টিভিশন এবং আইসিইউ সাপোর্টে নিতে হয়। উপজেলা পর্যায়ে এসব সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আমরা রোগীকে এমন সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করার পরামর্শ দেই। তাছাড়া, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন সীমিত। তবে, এই পরিস্থিতিতে জেলার সমন্বয় মিটিংয়ে চাহিদার কথা উপস্থাপন করা হয়েছে।

 আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের চাহিদা অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন পাব।’ হরিরামপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, ‘উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ীর চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেশি। গত তিন মাসেই এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন পাঁচ জন। সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই দুই জায়গা থেকে খবর এসেছে দুটি সাপকে এলাকাবাসী মেরে ফেলেছেন। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি।’  তিনি আরও বলেন, ‘এখন বোরো ধানের মৌসুম। তাই উপজেলা পরিষদ থেকে প্রথম অবস্থায় চরাঞ্চলের কৃষকদের বিশেষ জুতার (গামবুট) ব্যবস্থা করা হবে।’