• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চাঙ্গা শেয়ারবাজার ॥ ’১০ সালের বড় ধসের পর আশার আলো

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২০  

নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে দেশের শেয়ারবাজার। ২০১০ সালের বড় ধসের প্রায় এক দশক পর ফের শেয়ারবাজার ঘিরে আশার আলো দেখছেন বিনিয়োগকারী, অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। করোনা অতিমারীর মধ্যেও সরকারের শেয়ারবাজারমুখী ইতিবাচক মনোভাব, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে প্রধান বাজারের সার্বিক সূচকটি এখন বিগত ১৬ মাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে থাকার পর অতিমারী করোনার মধ্যে এই খাতটিতে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রধান শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগকারী বেড়েছে সোয়া এক লাখের বেশি। এছাড়া সম্প্রতি শেয়ারবাজার থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

শেয়ারবাজারে গুণগত পরিবর্তন আসায় দীর্ঘ সময় পর সক্রিয় হয়েছে মার্কেট প্লেয়াররা। বেড়েছে নতুন টাকার সরবরাহ। বর্তমানে নীতিনির্ধারণী মহল শেয়ারবাজারকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল বুথ স্থাপন, নতুন ট্রেক ছাড়া এবং এছাড়া সব বিনিয়োগকারীকে শেয়ার দিতে আইপিও নীতিমালা সংস্কারের মতো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সব মিলে দীর্ঘদিন পর যেন নতুন করে জেগে উঠছে শেয়ারবাজার।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা অতিমারীর সময় শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পতনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সার্কিট বেঁধে দেয়া, ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারল্য সহায়তার অংশ হিসেবে বিশেষ তহবিল গঠনে ছাড় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুনর্গঠন ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে গভীরতা বাড়ানো এবং পুঁজি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাও ভাল ভূমিকা রেখেছে।

ঢাকা স্টক একচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমান পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়পোযোগী সিদ্ধান্তে করোনাকালে শেয়ারবাজারে বড় পতন থেমেছিল। একইসঙ্গে বর্তমান পুনর্গঠিত সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের বহুমাত্রিক কার্যক্রমে শেয়ারবাজার নতুন করে সবার মাঝে আশার আলো জাগাচ্ছে। আগামীতে আরও আলো ছড়াবে বর্তমানের শেয়ারবাজার বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডিএসইর সাবেক এই সভাপতি।

নতুন বিনিয়োগকারী বেড়েছে সোয়া এক লাখ ॥ চলতি বছরে এক মাসেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী নতুন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) এ্যাকাউন্ট বেড়েছে প্রায় সোয়া এক লাখ। এর মধ্যে দেশী বিনিয়োগকারীদের বিও বেড়েছে লাখেরও বেশি। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিও বেড়েছে ২২ হাজার। অবশ্য আইপিও আবেদনকে ঘিরেও নতুন একঝাঁক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে এসেছেন। একইসঙ্গে ব্যাংকের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নতুন করে শেয়ারবাজারে আসছেন।

শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্যানুসারে, গত ১ নবেম্বর বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল২৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪৮৩টি। এক মাসের ব্যবধানে ১ লাখ ৪৭ হাজার বিও হিসাব বেড়ে ১ ডিসেম্বর দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ১০ হাজারে।

সিডিবিএলের তথ্যমতে, ২৫ লাখ বিওর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৬১টি আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরবিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৬৬০টি। ব্যক্তি শ্রেণীর বিওধারীদের মধ্যে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯৯টি। যা নবেম্বর মাসের একই সময়ে যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার ৩৪৭টি। অর্থাৎ পুরুষদের বিও বেড়েছে ১ লাখ ৮ হাজারটি। অন্যদিকে নারী বিও হিসাবধারীদের বেড়ে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬২টিতে দাঁড়িয়েছে।

স্থাপন হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউসের ডিজিটাল বুথ ॥ দেশের শেয়ারবাজার এবার বিদেশে ও দেশের মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউসগুলো চাইলে এখন দেশের মধ্যে ইউনিয়ন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌর সদর এলাকায় ব্রোকারেজ হাউসের ডিজিটাল বুথ খুলতে পারবে। একইভাবে বিদেশেও বুথ খুলতে পারবে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। বিএসইসি বলছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ও শেয়ারবাজারের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এ ডিজিটাল বুথ খোলার অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে বিএসইসি এই বুথ খোলার অনুমোদন দেবে।

২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস নামার পর থেকে বিএসইসি ব্রোকারেজ হাউসের শাখা খোলার অনুমোদন বন্ধ করে দেয়। তবে নতুন ব্রোকারেজ হাউসকে শাখা খোলার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দেশজুড়ে ব্রোকারেজ হাউসের শাখা খোলার হিড়িক পড়ে যায়। তাতে শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে দলে দলে লোক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুলে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু করে।

শেয়ারবাজার ধসের ১০ বছর পর সম্প্রতি শেয়ারবাজারে নতুন করে আবার গতি সঞ্চার হয়েছে। তাই নতুন করে ইউনিয়ন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌর সদর এলাকা এবং বিদেশে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বুথ খোলার অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এই সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের মধ্যে বুথ খোলার ক্ষেত্রে ১ লাখ ও বিদেশে বুথ খোলার ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জামানত রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসকে। ইউনিয়ন পর্যায়ে বুথের মাধ্যমে দিনে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ২ লাখ এবং সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকার বুথে দিনে সর্বোচ্চ পৌনে ৯ লাখ টাকা লেনদেন করতে পারবেন। আর বিদেশে স্থাপিত বুথের ক্ষেত্রে লেনদেনের এ সীমা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনানুযায়ী নির্ধারণ হবে।

দীর্ঘদিন ধরে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে শাখা খোলার অনুমোদন দেয়ার দাবি জানানো হচ্ছিল। এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিগত কমিশন এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে বিএসইসি পুনর্গঠনের পর বাজারে গতি ফিরে আসে। আর এ অবস্থায় নতুন কমিশন শেয়ারবাজারকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করার নানা উদ্যোগ নেয়। তারই অংশ হিসেবে ডিজিটাল বুথ চালুর নীতিমালা ও আদেশ জারি করা হয়।

ছাড়া হচ্ছে নতুন ট্রেক ॥ মাত্র পাঁচ লাখ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে মধ্যস্থতাকারীর অনুমতি মিলবে। ব্রোকারেজ হাউসের মতো শেয়ার কেনাবেচার অনুমতি পাবেন উদ্যোক্তারা।

সম্প্রতি কমিশন সভায় ট্রেক ইস্যুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন নীতিমালা গেজেট প্রকাশের পর ২০১৩ সালের ট্রেক ইস্যুর বিধিমালা বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গেজেট অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচার অনুমতি পেতে এক লাখ টাকা ফি দিয়ে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা ট্রেক আবেদন করতে পারবেন। দেশী-বিদেশী সবার জন্যই রেজিস্ট্রেশন ফি পাঁচ লাখ টাকা। তবে একক, দেশী-বিদেশী যৌথ ও বিদেশী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা আলাদা জামানত ও পরিশোধিত মূলধন নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম অনুযায়ী, এই স্কিম বাস্তবায়নের পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে একবার নতুন ট্রেক ইস্যু করতে হবে। ট্রেকধারীদের স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারধারী হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। তবে স্কিম কার্যকরের পাঁচ বছর পার হলেও নতুন ট্রেক ইস্যু করতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে ট্রেক ইস্যুর বিষয়ে দাবি জানিয়েছি আসছিল।

নতুন ট্রেক পেতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন ও স্টক এক্সচেঞ্জে তিন কোটি টাকার জামানত দিতে হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান শেয়ার কেনাবেচার লাইসেন্স পেতে স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে আবেদনও করেছে। তারা ট্রেক পেতে চাইলে ১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন ও জামানত দিতে হবে পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া দেশী ও বিদেশী উদ্যোক্তা মিলে যৌথভাবে ট্রেক পেতে চাইলে পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে আট কোটি টাকা আর জামানত চার কোটি টাকা।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোম্পানি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কমিশনের অনুমোদিত কোন প্রতিষ্ঠান স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেক কিনতে পারবেন। ফৌজদারি অপরাধে দ-িত, ঋণখেলাপী, অন্য কোন ট্রেক ধারক ও মিউচুয়াল ফান্ডসহ যৌথ বিনিয়োগ স্কিমের কোন শেয়ারহোল্ডারধারী ট্রেক পাবেন না। ট্রেক লাইসেন্সপ্রাপ্তরা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডার হবেন না। শুধু শেয়ার ও ইউনিট বেচাকেনার সুযোগ পাবেন। এই ট্রেক অহস্তান্তরযোগ্য। নিবন্ধন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা ২০০০ অনুযায়ী স্টক ডিলার বা স্টক ব্রোকার সনদ নিতে হবে। সনদ নেয়ার ছয় মাসের মধ্যে ব্যবসা শুরু করতে না পারলে ট্রেক বাতিল হবে।

আসছে দেড় হাজার কোটি টাকার আইপিও ॥ বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ছেড়ে সামনের দিনগুলোতে দুইটি ব্যাংকসহ মোট ১২ কোম্পানি এক হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন সংগ্রহ করার অনুমতি পেয়েছে। বিএসইসির অনুমোদন পাওয়া এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে চারটির আইপিওর চাঁদা তোলার সময়সূচী ঠিক হয়েছে। এনআরবিসি ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংক নামের দুটি ব্যাংকের আইপিও অনুমোদনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পরে ব্যাংকের মূলধন উত্তোলনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আইপিও (৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকা) সংগ্রহ করেছে টেলিযোগাযোগ খাতের দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি রবি আজিয়াটা। তার সঙ্গে ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেড ও ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডও নির্ধারিত মূল্যে টাকা সংগ্রহ করেছে। ইতিমধ্যে লটারি সম্পন্ন করে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স লেনদেন শুরুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সম্প্রতি এনার্জি প্যাকের আইপিওয়ের চাঁদা গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। আগামীতে মীর আক্তার হোসাইন, তৌফিকা ফুডস এ্যান্ড এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ই-জেনারেশন, লুব-রেফ বাংলাদেশ ও ইনডেক্স এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিওয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করবে।