• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

নজরুল-প্রমিলার স্মৃতিধন্য মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রাম

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২২  

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার সহধর্মীনি প্রমিলা নজরুলের স্মৃতি জড়িয়ে আছে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। ভালোবাসার টানে যমুনা নদী পাড়ের গ্রামটিতে কবি এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। তেওতা জমিদার বাড়ির পাশেই রয়েছে কবিপত্নী প্রমিলার জন্মভিটা। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটি এখন বেহাত হতে চলেছে। তাই বাড়িটি উদ্ধার করে সংরক্ষণের দাবি বিভিন্ন সংগঠনের।

নজরুল গবেষক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিয়ের আগে ও পরে তেওতা গ্রামে এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। তেওতা জমিদার বাড়ির শান বাঁধানো পুকুরে তিনি সাঁতার কেটেছেন।পুকুর পাড়ে বকুল তলায় বসে বাঁশি বাজিয়েছেন। জমিদার বাড়ির নবরত্ন মঠকে ঘিরে দোল উৎসবেও যোগ দিয়েছিলেন।

সবুজ-শ্যামল গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। কবি তেওতা গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাইতো তিনি লিখেছিলেন ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়।’ প্রমিলার প্রতি মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায় কে যায়, কে যায়।’ এছাড়া ‘ছোট হিটলার, লিচু চোর ও হারা ছেলের চিঠি’তে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তেওতা গ্রামের প্রতিচ্ছবি।

তেওতা গ্রমের বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ও গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দোলন বা দুলি। পরে ভালোবেসে কবি তার নাম দেন প্রমিলা নজরুল। জমিদার বাড়ির পাশেই ছিলো তাদের বাড়ি।

জানা গেছে, ১৯০৮ সালে তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আশালতা সেনগুপ্তা। তেওতা একাডেমি স্কুলে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় নায়েব পদে চাকরি করতেন। কাকা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন।

চাকরি সূত্রে ইন্দ্র কুমার পরিবার পরিজন নিয়ে কুমিল্লায় বসবাস করতেন। আর বসন্ত কুমারের পরিবার বসবাস করতেন তেওতা গ্রামে। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যু হলে কাকার সঙ্গে কুমিল্লায় চলে যান আশালতা ও তার মা।
কাজী নজরুল ইসলাম তার বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে একবার কুমিল্লায় বেড়াতে গেলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে আশালতার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপরই তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।


আশালতার সেনগুপ্তার টানে নজরুল কুমিল্লায় যান ৫ বার। আর তেওতা গ্রামে আসেন তিনবার। শেষবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে কবি কুমিল্লায় গেলে নজরুল-প্রমীলার প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এক পর্যায়ে নজরুল কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।

সামাজিক চাপে মা গিরিবালা দেবীও মেয়ে আশালতা ওরফে প্রমীলাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯২৪ সালে গিরিবালা দেবীর ইচ্ছায় নজরুল ও আশালতার (প্রমীলা) বিয়ে সম্পন্ন হয়।

নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতা গ্রামে প্রতিবছর তাদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। তারা দাবি জানিয়ে আসছে জমিদার বাড়ি ও প্রমীলার জন্মভিটা সংরক্ষণ করার।

নজরুল-প্রমীলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেন, নজরুল-প্রমীলার স্মৃতিধন্য তেওতা জমিদার বাড়ি দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে নানা বয়সী মানুষ আসে। তারা তেওতা গ্রাম আর জমিদার বাড়িটি দেখে মুগ্ধ হন। তবে সংস্কার না হওয়ায় জমিদার বাড়িটি এখন ভঙ্গুরদশা।

তিনি বলেন, প্রমীলার জন্মভিটাটিও এখন বেহাত হওয়ার পথে। সিএস রেকর্ডে প্রমীলার বাবা ও কাকাদের নাম থাকলেও, এসএ, আরএস রেকর্ড হয়েছে অন্যদের নামে। এরইমধ্যে তিন দলিলে জমির মালিকানাও পরিবর্তন হয়েছে। সিএস থেকে অন্যদের নামে কিভাবে জমি রেকর্ড হলো সে বিষয়ে খতিয়ে দেখার দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল-প্রমীলা সংগঠক আতিকুর রহমান আতিক জানান, প্রমীলার জন্মভিটা ও তেওতা জামিদার বাড়ি সংরক্ষণ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনস্টিটিউট অথবা যাদুঘর নির্মাণের দাবি তাদের দীর্ঘদিনের। এজন্য নজরুল-প্রমীলা স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে দাবি জানিয়েছেন।

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, আইনি জটিলতা থাকায় প্রমীলার জন্মভিটা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। জমিটি পর পর দুটি রেকর্ড এবং তিন দলিলে হাত বদল হয়েছে। যারা বসবাস করছেন তারা জমিটি কিনে নিয়েছেন। একমাত্র অধিগ্রহণের মাধ্যমে সরকার সেখানে স্থাপনা করতে পারে। এ বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে তিনিও মনে করেন নজরুল-প্রমীলার স্মৃতি বিজড়িত তেওতায় তাদের স্মৃতি স্মরণে কোনো স্থাপনা হওয়া প্রয়োজন। এতে পর্যটন সম্ভবনাও তৈরি হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।