• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২১ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

বাবার প্রশ্রয়ে বখে যায় দু্ই ভাই

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১ জুলাই ২০১৯  

কাউকে মারধর করে জখম বা লাঞ্ছিত করলে বাবা সন্তানদের শাসন করেন। তবে সেই নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন বরগুনায় দিনে-দুপুরে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড মামলার অন্যতম আসামি রিফাত ও রিশান ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজী। বরং ছেলেদের প্রশ্রয় দিয়ে এসব কাজে উৎসাহ দিতেন তিনি। এতে প্রতিবাদ করেও কোণঠাসা হতেন তাদের মা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুলাল ফরাজীর বাড়ি জেলা সদরের বুড়িরচর ইউপির সোনাতলা গ্রামে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বরগুনা পৌরসভায় চার নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কের পাশে জমি কিনে বাড়ি করেন। সেখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা রিফাত ও রিশানের। বড় ছেলে রিফাত কিশোর বয়স থেকেই বখাটে স্বভাব ছিল। মাধ্যমিক স্তর অতিক্রমের আগেই পড়াশোনা সাঙ্গ হয় তার। ছোট ছেলে রিশান বরগুনা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও রিশানের ওপর বড় ভাইয়ের প্রভাব লাগে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ‘বড় ভাই’ হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে উভয়কে। ‘বড় ভাই’ হওয়ার মিশনে কারণে-অকারণে বা তুচ্ছ বিষয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণি পেশার লোকদের লাঞ্ছিত করতে থাকে। এরই মধ্যে রিফাত শরীফ হত্যার মূল অভিযুক্ত চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত ফরাজীর সখ্যতা গড়ে ওঠে।

অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, ২০১৭ সালের দিকে তৈরি হয় বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপ। গ্রুপে সহযোগীদের পাশাপাশি যুক্ত হয় বেশ কিছু উঠতি তরুণ। এলাকায় নতুন তরুণের আকস্মিক আগমন ঘটলে তাকে গ্রুপের সদস্য হতে বাধ্য করা হয়। রিফাত ফরাজী মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে নয়নের সঙ্গে সখ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রুপ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে কলেজে ও বিভিন্ন মেসে হানা দিয়ে ও ছাত্রদের মোবাইল জিম্মি করে অর্থ আদায় চলে। আর এসব অপকর্মের নালিশ আসলে বাবা দুলাল ফরাজী প্রথমে স্বীকারই করতেন না। তিনি বলতেন তার ছেলেরা এমন কর্ম করতেই পারে না। পরে প্রমাণ মিললেও সাফাই গাইতেন ছেলেদের পক্ষে।

কেজি স্কুল এলাকার বেশ কয়েকটি মেসের ছাত্ররা জানায়, রিফাত ও রিশানের কাজই ছিল নিয়মিত মেসে হানা দিয়ে মোবাইল ও ল্যাপটপ কেড়ে নেয়া। মেস মালিকদের বিষয়টি জানালে তারা রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে ডেকে পাঠাতেন। সব সময় দুলাল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ছেলেদের সাফাই গাইতেন।

শহরের কাঠপট্টি এলাকার বাসিন্দা আজীম মোল্লা জানান, মাস খানেক আগে দীঘির পাড় এলাকার তার একটি মেসে থেকে ১৪টি মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ কেড়ে নেয় রিফাত বাহিনী। বিষয়টি বাবা দুলাল ফরাজীকে জানালে তিনি এর পক্ষে প্রমাণ চান। প্রমাণ দিলেও তিনি ছেলেদের পক্ষাবলম্বন করে নির্লিপ্ত থাকেন। পরে আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে একটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। আজিম বলেন,‘ওদের বাবা দুলালের কারণেই ছেলেদের এ দশা। ছেলেদের শাসন তো দূরে থাক, পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইতেন। এমনকি লেলিয়ে দিয়ে অভিযোগকারীকে অপদস্থও করতেন।

ক্রোক এলাকার জাকির হোসেন বলেন, এলাকায় এমন কোনো ছাত্রদের মেস নেই, যেখানে দুলালের ছেলেরা হানা দেয়নি। আমি বেশ কয়েকবার মোবাইল উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। দুলাল ফরাজীর আশকারায় দিনে দিনে ছেলেদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ায় এতো বড় ঘটনার জন্ম হয়েছে।

ধানসিঁড়ি সড়কের রিফাত ও রিশানের বেশ কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা হয়। সড়কের দক্ষিণ প্রান্তের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দুলাল কোনো কাজ করতো না। ছেলেদের হাতিয়ে নেয়া অর্থ দিয়ে সে চলতো। যে কারণে ছেলেদের ব্যাপারে কেউ অভিযোগ দিলেও উল্টো তাকে ছেলেদের সামনেই ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিত। ওর ছেলেদের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিল।

দুলাল ফরাজী ও তার ছেলেদের সম্পর্কে জানতে চাইলে এক নারী বলেন, তিনি দুলাল ফরাজীর বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। ছেলেদের বিরুদ্ধে নালিশ এলে রিফাত ও রিশানকে বকাঝকা করতেন মা রেশমা বেগম। দুলাল ফরাজী তখন ছেলেদের পক্ষ নিয়ে উল্টো স্ত্রীকে মারধর করতো। দুলাল ফরাজী ছেলেদের অপকর্মের পক্ষ নেয়া কারণ ছিল তার ছেলেরা ‘কামাইয়ের পুত’।

অভিভাবকদের এমন নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, পারিবারিক অনুশাসন না থাকলে বেশির ভাগ সন্তান বখাটে হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা প্রমাণ করেছে আমাদের নৈতিক অবক্ষয় কতটা নিম্নগামী। এ ঘটনার জড়িতদের অনেক অভিভাবকই ছেলেদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। ঘটনাটি থেকে সব অভিভাবকের শিক্ষা নেয়া উচিত।