• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২১ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ এর অজানা কথা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯  

বছর ঘুরে আবার আমাদের দ্বারপ্রান্তে নতুন বছর। কাল-কালান্তর ধরে এদেশে তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে। হিজরি, ইংরেজি ও বাংলা। প্রত্যেক বর্ষেরই আছে আবার বিস্তৃত ইতিহাস। আজ দিন পেরুলেই হাজির হবে ইংরেজি ২০২০ সাল।

এবার তবে জেনে নিন কীভাবে এলো ইংরেজি নববর্ষ? 

আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। তবে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয় সভ্যতার (বর্তমান ইরাক) লোকেরা নতুন বছর উদযাপন শুরু করে। তারা তাদের নিজস্ব গণনা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করত। তবে রোমে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।

রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের অন্তর্গত বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। জানুস হলেন প্রবেশপথ বা সূচনার দেবতা। তার নাম অনুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম জানুয়ারি নামকরণ করা হয়। এ তো গেলো যিশুর জন্মের আগের কথা। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন। যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।

নতুন বছর পালন-

আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ ইয়ার পালন শুরু হয় ১৯ শতক থেকে। নতুন বছরের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর হচ্ছে নিউ ইয়ার ইভ। এদিন নতুন বছরের আগমনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। ইংরেজি নতুন বছরকে ঘিরে বাংলাদেশেও উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এদিকে ইংরেজি নতুন বর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ইসরায়েল, দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। 

কারণ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অ-ইহুদি উৎস হতে উৎপন্ন এই রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। বিভিন্ন দেশে নতুন বছরের প্রথম দিনটি পাবলিক হলিডে। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা এক মিনিট থেকেই শুরু হয় নতুন বছর উদযাপনের উন্মাদনা। আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির আলোকছটা। বিশ্বব্যাপী নিউ ইয়ার ডে সর্বজনীন একটি উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে।

ইতিহাস-

আসলে আমরা যে ইংরেজি সাল বা খ্রিষ্টাব্দ বলি সেটা হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আমরা এখন যে ইংরেজি বর্ষ পালন করি তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। এর কিন্তু আবার আছে বিশাল ইতিহাস। আগে আমরা জেনে নেই সেটি।

গ্রেগরিয়ান আসলে একটি সৌর বছর। এর বর্তমান কাঠামোতে পৌঁছাতে সময় লেগেছে কয়েকশ’ বছর। নানা পরিবর্তন পরিমার্জনের ফল আজকের ক্যালেন্ডার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানুষ যেদিন বর্ষ গণনা করতে শিখলো সেদিন চাঁদের হিসাবেই শুরু করে বর্ষ গণনা। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর এবং চন্দ্র গণনায় আবার পার্থক্য রয়েছে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, কিন্তু চন্দ্র গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না।

বর্ষপঞ্জিকা তৈরির বিষয়টি লক্ষ্য করা গিয়েছিল সুমেরীয় সভ্যতায়। মিশরীয় আবার জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিসাব-নিকাশে ছিলো বেশ এগিয়ে। এই মিশরীয় সভ্যতাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সৌর ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করে বলে ধারণা করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মিশরীয় সে ক্যালেন্ডার নিয়ে করেছেন বিস্তৃত গবেষণা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। ইউরোপকে বলা হয় শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্গ। সভ্যতার সব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কিন্তু তারাই করেছে। আর এদিক দিয়ে এগিয়ে ছিলো গ্রিক ও রোমনরা।

রোমানরা আবার তাদের প্রথম ক্যালেন্ডার লাভ করে গ্রিকদের কাছ থেকে। মজার বিষয় রোমানদের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে মাস কিন্তু ১২টি ছিল না। তাদের মাস ছিলো ১০টি। তাদের বছর ছিল ৩০৪ দিনে। আরো মজার ব্যাপার শীতের দুই মাস তারা বর্ষ গণনার মধ্যেই আনতো না। রোমানরা মার্চ মাস থেকে তাদের বর্ষ গণনা শুরু করত। নববর্ষ উৎসব পালন করতো মার্চ মাসের ১ তারিখে। বছর গণনায় ৬০ দিন বাদ যাওয়ায় তারা কিন্তু দিন, তারিখ বর্ণিত ক্যালেন্ডার ব্যবহারের কথা ভাবত না।

রোমের একজন বিখ্যাত সম্রাট রমুলাস। তিনি ছিলেন রোমের প্রথম সম্রাট। তিনিই নাকি আনুমানিক ৭৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার চেষ্টা করেন। তবে পরবর্তীকালে ১০ মাসের সঙ্গে আরো দুটো মাস যোগ করেন রোমান সম্রাট নুমা। আর মাস দুটো হচ্ছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। তিনিই জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে যুক্ত করেন। জানুয়ারি মাস ২৯ দিনে এবং ফেব্রুয়ারি মাস ধার্য করা হয় ২৮ দিনে। আরো মজার ব্যাপার এই বারো মাসের বাইরে তিনি মারসিডানাস নামে অতিরিক্ত একটি মাসেরও প্রবর্তন করেন। মাসটি গণনা করা হতো আবার ২২ দিনে। এ অতিরিক্ত মাসটি গণনা করা হতো এক বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ থেকে ২৪ তারিখের মাঝখানে।

নুমা চালু করা মাসের হিসাব পরিবর্তন করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দে। আমরা এখন যে লিপ ইয়ার পালন করি চার বছর পর পর তার প্রবর্তকও কিন্তু এই রোমানরাই। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার রোমে চালু করেন নতুন ক্যলেন্ডার। তিনি মিশরীয় ক্যালেন্ডার নিয়ে আসেন রোমে। জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সেই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মাঝখানে ৬৭ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৩ দিনসহ মোট ৯০ দিন যুক্ত করে সংস্কার করেন ক্যালেন্ডার। পরবর্তে এ ক্যালেন্ডার পরিচিত হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে মার্চ, মে, কুইন্টিলিস ও অক্টোবর মাসের দিন সংখ্যা ৩১ এবং জানুয়ারি ও সেক্সটিনিস মাসের সঙ্গে দুইদিন যুক্ত করে ৩১ দিন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাস গণনা হতে থাকে ২৮ দিনেই। আমরা যাকে এখন লিপইয়ার বলি সেই ফ্রেব্রুয়ারি মাসে প্রতি চার বছর অন্তর যুক্ত করা হয় একদিন। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে প্রাচীন কুইন্টিলিস মাসের নাম বদলিয়ে রাখা হয় জুলাই। আরেক বিখ্যাত রোমান সম্রাট ছিলেন অগাস্টাস। তার নামানুসারে সেক্সটিনিস মাসের নাম পাল্টিয়ে করা হয় অগাস্ট। ৩৬৫ দিনে সৌর বর্ষ গণনার কাজটা করত মিশরীয়রা। তবে জুলিয়াস সিজারের সংস্কারের ফলে তা এসে দাঁড়ায় ৩৬৫ দিনে।

আমরা যে খ্রিষ্ট বছর বা খ্রিষ্টাব্দ বলি, তার সূচনা হয় আরো পরে। খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিষ্টের জন্ম বছর থেকে গণনা করে ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রী ৫৩২ অব্দ থেকে সূচনা করেন খ্রিষ্টাব্দের। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। তার নির্দেশে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে দেয়া হয় ১০ দিন। এর ফলে ওই বছরের ৫ তারিখকে করা হয় ১৫ তারিখ।

পরে পোপ গ্রেগরি ঘোষণা করেন, যেসব শতবর্ষীয় অব্দ ৪০০ দিয়ে বিভক্ত হবে সেসব শতবর্ষ লিপ ইয়ার হিসেবে গণ্য হবে। পোপ গ্রেগরি প্রববর্তিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মোটামুটি একটি নিখুঁত হিসাবে আমাদের পৌঁছে দেয়। বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। আজ আমরা যে ক্যালেন্ডার দেখে ইংরেজি বর্ষ হিসাব করি, উদযাপন করি নববর্ষ, তা সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ফসল।