• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

চার নারীর ভাগ্য বদলের যুদ্ধ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ মে ২০১৯  

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলায় শিক্ষা-চাকরি, সফল জননী, দরিদ্রতা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে চারজন জয়িতা নারী নির্বাচিত হয়েছেন

তারা হলেন- শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী শিল্পী রানী সূত্রধর, সফল জননী নারী রুবি আক্তার, দরিদ্রতাকে মুছে ফেলা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতায় ছখিনা বেগম ও নির্যাতনে বিভীষিকা মুছে ফেলা নতুন উদ্যোমে মাহবুবা ইসলাম

দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া ইউপির গাজীছাইল গ্রামের নিমাই চন্দ্র সূত্রধরের মেয়ে শিল্পী রানী সূত্রধর জানান- আমার জন্ম অতিদরিদ্র একটি পরিবারে যে সংসারে শুধু দারিদ্রতার প্রভাবই নয়, অশিক্ষার প্রাচীর দ্বারা ঘেরা পরিবারটি টাকার অভাবে স্কুল-কলেজ কি জিনিস আমি বুঝতে পারিনি আমার পিতার নিজস্ব কোন জমি ছিল না, অন্যের বসত-ভিটায় ঘর তুলে থাকি পাড়ার ছেলে-মেয়েরা যখন বই নিয়ে স্কুলে যায় তখন আমারও তাদের মত স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত মা-বাবাকে বলেছিলাম আমি স্কুলে যাব, বাবা বলেছিল স্কুল তোদের জন্য নয়, ধনী লোকদের সন্তানদের জন্য হচ্ছে লেখা-পড়া এ কথা শোনার পর আমি কষ্টে ভেঙ্গে পড়েছিলাম

একদিন এক ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়ন কর্মী আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনা পয়সায় স্কুলে ভর্তি এবং বই দেয়া হয় সে থেকে আমি স্কুলে ভর্তি হই পাশের বাড়ির মেয়েদের দেয়া পুরাতন জামা-কাপড় পড়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করি প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমি দ্বিতীয় স্থান লাভ করি আমি লেখা-পড়ার পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস, মুরগি ও ছাগল পালন শুরু করি অষ্টম শ্রেণি পাশ করার পর টিউশনী করি এভাবেই এসএসসিতে ৩.৬৩ ও এইচএসসিতে ৪.২৮ পাই পরে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বিবিএস ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ২য় বিভাগে পাশ করি এবং এমবিএস ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করি আমি বর্তমানে মানিকগঞ্জ হোলি চাইল্ড স্কুলে শিক্ষকতার পাশা পাশি টিউশনী করে আমার দরিদ্র বাবাকে সংসার চালাতে সাহায্য করছি এবং ছোট ভাইয়ের লেখা-পড়ার খরচ চালাই পাশাপাশি গ্রামের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতায় কাজ করছি  

উপজেলার চকমিরপুর ইউপির দৌলতপুর গ্রামের মো. লুৎফর রহমানের মেয়ে রুবি আক্তার জানান, আমার জন্ম অন্ধকারে ঘেরা এক অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে দারিদ্রতা ও অর্থ অভাবের কারণে স্কুলে পাঠায়নি পরিবার একদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা আমাদের বাড়িতে এসে মা-বাবাকে বুঝান এবং বলেন স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি ও বই দেয়া হয় পরে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় আমি প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত দ্বিতীয় স্থান লাভ করি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর দৌলতপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর থেকে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াই এস.এস.সি পাশ শেষে যুব উন্নয়ন অফিস থেকে সেলাই, কম্পিউটার ও গবাদি পশু পালনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি আমি বর্তমানে দৌলতপুর সরকারি মতিলাল ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত আছি অদম্য পরিশ্রমই সফল জয়িতা জননী রুবি আক্তার সকলের দোয়া চেয়েছেন

উপজেলার চকমিরপুর ইউপির চরমাস্তুল গ্রামের মো. সুরুজ মন্ডলের স্ত্রী ছখিনা বেগম জানান, আমি আমার বাবার প্রথম কন্যা সন্তান বাবা একজন প্রতিবন্ধী ও হতদরিদ্র মানুষ, দারিদ্রতা কি জিনিস তা আমি ছোট থেকেই বুঝেছি আমাদের সম্বল বলতে ছিল থাকার একটি ছোট ছনের কুঁড়ে ঘর বাবা ১২ বছর বয়সেই গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আমাকে বিয়ে দেন স্বামী একজন ভ্যানচালক, তার রোজগারের টাকা দিয়েই অভাবের সংসার চলত সংসারে অভাব কিছুটা দূর করতে আমি ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ব্র্যাকের গণনাটক দলে যোগ দেই, এখান থেকে কিছু ভাতা পাই পাশাপাশি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে নকঁশীকাঁথা সেলাই এবং হাঁস-মুরগি পালন শুরু করি বর্তমানে দুই বিঘা জমি, চারটি গরু ও পাকা একটি ঘর করেছি আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে লেখাপড়া করছে বর্তমানে সমাজে আমি স্বচ্ছলভাবে চলছি

 

উপজেলার চকমিরপুর ইউপির দৌলতপুর গ্রামের মো. আব্দুল রহমানের মেয়ে মাহবুবা ইসলাম জানান, আমার বাবা মৃত্যুবরণের পর মা আমাকে খুবই কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করেন বাবা মারা যাওয়ার সময় আমার বড় ভাইয়ের বয়স তখন পাঁচ বৎসর অর্থাভাবে মা আমাদের পড়াশুনা করাতে না পাড়ায় ভাইকে ঢাকায় কাজে পাঠিয়ে দেয় ভাইয়ের রোজগারের পাঠানো সামান্য টাকা দিয়ে মা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ধান ছাটাই করে আমার পড়ার খরচ চালাতো এভাবে আমি গত ২০১১ সালে এসএসসি পাশ করি, পাশা পাশি প্রাইভেট পড়াই গত ২০১৩ সালে এইচ.এস.সি পাশ করি ভাগ্যের চাকায় ২০১৩ সালে আমার বেকার একটি ছেলের সাথে বিবাহ হয় আমার একটি কন্যা সন্তান আছে, কন্যা সন্তানের কারণে শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে দেখতে পারে না এখন আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি যুব উন্নয়ন অফিসের মাধ্যমে সেলাই কাজ শিখেছি, স্বামী একটি কসমেটিকস্ দোকান দিয়েছে

 

এদিকে দৌলতপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছা. আকলিমুন নেছা জানান, সরকারিভাবে যত ধরণের মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে সব সেবা নারীদের দেয়া হচ্ছে এবং সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা জেলা ও উপজেলা থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নারীরা সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে জয়িতা নারীদের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সম্মাননা ও ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে