• বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

  • || ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

ঢেকে গেছে ঢাকা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৩ জুন ২০১৯  

দুচোখ যেদিক যায় চলে যাব। ঢাকা থেকে অনেক দূর। থাকুক কাক কবি আর লেজেগোবরে গাদাগাদি করা উচ্চমার্গের সুশীল এখানে। যে শহরে, নর্দমার চেয়ে ভাল একটি নদী নেই, গাড়ির গায়ে গাড়ি, নারীর গায়ে বাসযাত্রী হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি জানেন আমি কে’? রেডিও শিলং এর আবহ সঙ্গীতের মত বাজতে থাকে। থাকুক সেখানে কিছু সাহসী মানুষ, লেজ কাটা সততা আর মস্তান মন্ত্রীসহ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ গজান দাপুটে হিংসকের দল।

ওদের ভয়ে ইঁদুরের মত গুটিয়ে থাকা কয়েকজন সৎ কর্মচারীর জন্য দুঃখ হবে। আমাকে বলুক কাপুরুষ কিছু লোক। হাসপাতালের বারান্দায় গোঙরানো মানুষগুলোর কোন কাজে আসবো না জানি। রানা প্লাজার মত কারবালার সময় খোন্তা কুড়াল নিয়ে এগিয়ে যাবার কাজে ইস্তফা দিলাম। সে লজ্জা আমাকে কুরে কুরে খাবে। পড়ে থাকবে নাট্যমঞ্চের আরও একটা সিট খালি। ঢাকা শহর আমাকে কতটুকু চায় তাও ভাববার বিষয়। আমি চাইলে ঢাকা আমাকে কেন চাইবে না- এমন তর্কে যেতে চাই না।

বুঝলাম জন্ম হয়েছিল বলে জন্ম সূত্রে আমি এই শহরের লোক। সত্য কথা হলো, এখানে বসেই গাছগাছালি ফুল পাখিদের নাম শিখেছিলাম। বহুযুগ আগে রানী ভিক্টোরিয়া কোথায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়েছিলেন নেটিভদের জন্য সেই পার্কের দোলনায় দোল খেতে খেতে রেখে এসেছি ছেলেবেলা। একদা কৈশোরে পালিয়ে যেতাম রমনা ময়দান। ঘোড়দৌড় দেখে নিজের দৌড় দেবার শক্তি মেপে দেখতাম।

তাতে কী! ওসব আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবই ‘দুর্লভ ছবি’ শিরোনামে ছাপা হয়ে বইয়ের পাতায়। আমার যৌবন কেটেছে যেথায় সেখানে এখন বানভাসি গতরপোষা কিশলয়, উপাসনালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। ঘরে ঘরে বালিশের ওয়ারের মত ছতর বতর ঢাকা সন্দেহ বাতিকের দল।

এক সময় কবির লেখা বনলতা সেন ভুত দেখার মত আসতো আমার বাড়ির আঙ্গিনায়। সেকথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। এখন নব্য ঢাকাবাসী বলে হিন্দু মেয়েদের নিয়ে ভাবতে নেই, হোক সে চুল খোলা সুন্দরী নারী। টেক্কা মারা গলাবাজিতে ছেয়ে গেছে নোংরামি। এর গায়ে ওর ঘুষি। একের পায়ে অন্যের পাড়া, লাথি, তুই তামারি। কে কত বড় ঋষি তাই মাপা হয় বাটখারা দিয়ে। মানুষ দেখে না কেউ।দেখে দানব হবার নয়নাভিরাম দৃশ্য। গুলশান বনানী পিঙ্ক সিটি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।

মনে আছে খালি পায়ে যেতাম খেলার মাঠে আবার খালি পায়ে আসতাম ঘরে। সবুজ ঘাস ছিল কতটুকু মনে নেই তবে, ভয় ছিল না মনে। ধর্ষণের নাম শুনিনি জীবনেও। তেমন কিছু হতো যদি তবে বাড়িতে ডাকাত আসতে হতো। মা খালাদের ফিসফিস করে বলতে শুনেছি- দু’নালা বন্দুক নিয়ে এসেছিল ডাকাত সর্দার। বড় মেয়েটা ছিল ঘরে, ওকে আটকে রেখেছিল। ব্যাস এতোটুকুই ধর্ষণ সমাচার। এতোই ফিসফিস যেন বাড়ির পুরুষেরা শুনতে না পারে। বাচ্চাদের শোনার তো প্রশ্নই আসে না। অথচ এখন বাচ্চারা গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে ধর্ষকের ফাঁসি চায়।

খুব স্পষ্ট করেই বলতে পারি নিরাপদ চলাচল অবিকল সেই ছেলেবেলার মত হবার সম্ভাবনা নেই ঢাকা শহরে। ঐ দেখা যায় তালগাছ তার পাশেই বন্ধুর ঘর। এমন করে পথহারা কাউকে সাহায্য করার সুযোগ নেই। কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান কোথাও কোন বাগান বেঁচে নেই। ঢাকা শহর সত্যি ঢেকে গেছে। মাটি নেই কোথাও।

তবে কেন মিছেমিছি ফরমালিন মাখা তিলোত্তমা শহরে পড়ে থাকবো যখন আমার মত পলাতক মনের সবাই চলে গেছে সব ছেঁড়ে ছুঁড়ে গ্রামে, প্রবাসে কিংবা কেউ কেউ আকাশে। তার চেয়ে ভাল দূরে গিয়ে দেখি কাছের শহর। যা একদা আমার ছিল অথচ হরণ করে নিয়েছে বড় হবার স্বপ্ন।

এই শহরে একদিন ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম মিষ্টি একটি মেয়ের জন্য। রিক্সায় হুড তুলে দিলে আমাদের দুজনের মধ্যে বেহেশত চলে আসতো। সেই শহর বড় হতে হতে এত বড় হয়ে গেছে যে, রাজ্যের ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যৌবনের প্রেম।

যতদূর মনে পড়ে শুরুটা হয়েছিল ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন তুলে দিয়ে। তখন আমি খুব ছোট তবুও বুকের মধ্যে একটা জট পাকিয়ে গিয়েছিল। টিনের চালের সেই ফুলবাড়িয়া স্টেশনটা আর থাকবে না! আহা কত কী খাবার পাওয়া যেত প্লাটফর্মে।

এরপর তুলে নিলো নবাবপুর রেল ক্রসিং যা ছিল পুরনো ঢাকা আর নতুন ঢাকার সীমানা। গুলিস্তানের কামানটাও এদিক সেদিক হলো কয়েকবার। শুকিয়ে গেল ধোলাই খাল। একদিন ভেঙ্গে দিল হাতির পুল। তেজগাঁও বিমানবন্দর জৌলুশ হারিয়ে নত হয়ে গেল বারংবার নাম বদলানো বিমানবন্দরের কাছে। ঘোষণা দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হলো তমিজ মিয়াদের গরুর গাড়ি।

এসব দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম নরম বাতাস গায়ে লাগা ঢাকা শহর বদলে যাবে একদিন। হাত ফসকে যাবার মত মাটিতে পরে থাকবে কিছু মূল্যবান স্মৃতি। বীর দর্পে ঘুরে বেড়ানো এই ঢাকা শহরে একদিন আমাকে কেউ চিনবে না। আজ সেই দিন এসে গেছে।  

তাই আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দিচ্ছি। লিখে দিচ্ছি সত্য কাহন। এ ঢাকা আমি চাই নি। এ শহর বড়ই অচেনা।

হয়তো আমার প্রথম ভালোবাসা এখনো আছে ঢাক শহরে। অথবা সেও ছেড়ে গেছে  ঢাকা কিংবা এই নশ্বর পৃথিবী। যদি ইচ্ছেগুলো আগের মত দখলে থাকতো, তাহলে চিৎকার করে তাকে ডাক দিতাম। অনেক কথা বলতাম চেনা মানুষগুলোর সাথে।  

এইতো সেদিনের কথা। নিউমার্কেট থেকে গ্রিন রোডের রিক্সা ভাড়া ছিল চার আনা। দুই টাকা সের গরুর মাংস চার টাকায় খাসি। স্বর্ণের ভরি ছিল দুইশ ষাট।

তখন কৃষ্ণচূড়া জানিয়ে দিত বসন্তের আগমন। ছেলেমেয়ে মিলেমিশে কুঁড়িয়ে আনতাম ঝরে পড়া শিউলি বকুল।

গ্রিলের জানালা বলে কিছু ছিল না। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার, টেলিভিশনের মত কিছু ছিল না। ঘুমটা অনেক লম্বা হতো। গাছগাছালি ছিল খেলার অংশ। মাটির কলস ছিল ঠাণ্ডা পানির পাত্র। কাছের মানুষগুলোকে মনে হতো দুনিয়া। সারাদিন সারা বেলা যেন নিজের দখলে রাখা সময়। মেইড ইন আমি চিহ্ন সর্বত্র।

যদি ফিরে পাই হারানো যৌবন তবে ফিরিয়ে দেবে তাকে। একা একা ভালো থাকা যায় না। সুখ নেই একাকিত্বে। কোথায় গেল সব খেলার সাথী? তখন মা খালাদের দেখতাম দুপুরের ভাত ঘুম দিতো। ‘লেইস ফিতা’, ‘সাপের খেলা’ ‘জুতা সেলাই’ অপেক্ষার সেই ডাকগুলো আর নেই। বাবা মানেই সংবিধান এমন সমাজ কই। বই ছিল বিনোদন। ভাঙ্গা মাটির চাড়া দিয়ে খেলতাম সাত চাড়া, টিলু বলে হারিয়ে যেতাম। ঝিনুক ধারে সবুজ আম কেটে খেতাম। সবই করেছি ঢাকা শহরে।

আমাদের মহল্লায় রাতে নাইট গার্ড পাহারা দিত। ‘সাবধান হুশিয়ার’ হাঁক দিয়ে অন্ধকার পথ দিয়ে প্রতি রাতে হেটে যেত। কিন্তু কখনো সে একটা চোর ধরেছে বলে শুনিনি।

ঘরের বাইরে যাবার সময় মাকে দেখতাম শিকল উঁচিয়ে দরজা লাগাতেন। যা অনায়াসে যে কেউ খুলে ফেলতে পারতো। অথচ কেউ সেটা করতো না।

বিশ্বাসের পাটাতনে বাঁধা ছিল সমাজ। মনে মনে ফিরে চাই সেই ঢাকা শহর। যার সত্তর ভাগে ছিল লাল মাটির উঁকিঝুঁকি। পুকুর ছিল পাড়ায় পাড়ায়।

হাঁ তখন ছেলে ধরা বলে একটা কথা শোনা যেত। ছিল আরো কিছু ভয়। অসুখ-বিসুখ হতো হর-হামেশা। দাগ কাটা শিশিতে তেঁতো ওষুধ খেতে হতো। সেভেন-ও-ক্লক ব্লেড দিয়ে হাজাম মুসলমানি করাতো। রিক্সায় চেপে ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে ফোন করতে হতো। সে সমস্ত দিনে মুড়লির চেয়ে ভালো কোন স্নাকবার ছিল না। বাড়িতে মেহমান এলে চানাচুর আর বাখরখানি হতো নাস্তা। তবুও সেসব ছিল অমূল্য। ভালোলাগা মোড়কে ছাপানো জীবন গ্রন্থ।

ভাবছি চলে যাব গ্রামে। জ্ঞাতি গুষ্টির হাত-পা ধরে চেয়ে নেব বাবার ফেলে আসা জমি-জিরাতের অংশ। যা তিনি ছেড়েও আসেননি আবার বিকিয়েও দেননি। নগর সভ্যতায় সন্তানদের গড়ে তুলবেন বলে ওদিকে আর পিছু ফিরে দেখা হয়নি তার।

বাবার ফেলে আসা জমিতে যারা গরু চড়িয়েছে, ফসল কেটে নিয়ে গেছে ঘরে। তাদের বলবো সামান্য একটু থাকার জায়গা ফিরিয়ে দিতে। সাথে পা চালিয়ে হাঁটাহাঁটি করার মত একটা উঠান। বাকীটা তাদের কাছেই থাক যার ষোলআনা মালিক আইনত আমি।

যদি ফিরে পাই গ্রাম্য পরিচয় তবে একটা দেবদারু গাছ লাগাব, পাশাপাশি দুটো কৃষ্ণচূড়া। আবারো সেই দুচালা ঘর তুলবো, স্মৃতিতে যা এখনো ফুপুদের আতুর ঘর নামে পরিচিত। অতঃপর বসে বসে তসবি নেড়েচেড়ে মুরুব্বি হয়ে উঠবো। যেমনটা ছিলেন আমার দাদা হাতেম মুন্সি।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যদি ভালোবাসা না থাকে তবে যেখানে চলে যেতে চাই সেখানে চলে গেলে দোষ হবে কী?

হয়তো পরিচিত কেউ নেই গ্রামে কিংবা যারা আছেন তারা কেউ আমার খেলার সাথী ছিল না কখনো। তবে তারা এখনো এত ব্যস্ত নয় যে ডাক দিলে কথা শুনবে না। বসতে বলা মানেই যে গল্প বলা সে কথা বুঝবে না। একতালা দুতালা তিনতালা নিয়ে সারাক্ষণ কান ঝালাপালা করে দিবে না।

আর আগ্রহ! মানে আমার প্রতি ঝুঁকে থাকার কিছুটা আগ্রহ কি কেউ দেখাবে না সেখানে? কেন দেখাবে না, আমার ঝুলিতে কী গল্পের কমতি আছে? আমি আইয়ুব খান দেখেছি, চু এন লাই দেখেছি। দেখেছি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জানাজা। একটুর জন্য বায়ান্ন দেখা হয় নি, কিন্তু তারপর কিছুই বাদ দেই নি। একাত্তরের পাতায় তো একটি অক্ষর হয়ে বসে আছি।

তাই চেষ্টা করে দেখি, যদি নতুন করে ভালোবাসার সুযোগ পাই, পাওয়া যায় কিছু ছায়া, বৃষ্টি বাদল কাঁদা মাখামাখি। আর যদি জানতে পারি বাবার ছেলে বেলার কথা। আমি যতই বড় হই না কেন বাবা তো ছিলেন আরও বড়।

তাই কেন বসে থাকবো ঢেকে থাকা ঢাকাতে। মাটির উপর হেটে বেড়ানোর সখ কেন নিবু নিবু করবে! এ মাটি আমার। অতঃপর আমিও মাটি। মাঝখানে তবুও ইচ্ছে মত বেঁচে থাকা।